পবিত্র কুরআনের আলোকে মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ ঈমানের পরিচায়ক: মসজিদ আরবি শব্দ এর অর্থ সিজদার স্থান। শরয়ী পরিভাষায় সর্বোত্তম ইবাদত নামায আদায়ের জন্য নির্ধারিত স্থান, যা ওয়াকফকৃত হওয়া শর্ত। মসজিদের জন্য ওয়াকফ শর্ত। তবে নামাযের জন্য মসজিদ শর্ত নহে। আমাদের শরীয়তে প্রত্যেক স্থানে নামায পড়া জায়েজ, পূর্ববর্তী সম্মানিত নবীগণের শরীয়তে কেবল মাত্র নির্ধারিত ইবাদত খানাতে নামায ও ইবাদত করার বিধান ছিল। আমাদের ইসলামে নূর নবীজির শরীয়তে যে কোন পবিত্র স্থানে নামায পড়া বৈধ, তবে মসজিদে নামায আদায়ে অধিক ফযীলতের বর্ণনা ইসলামে ঘোষিত হয়েছে। মসজিদ আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদের প্রতীক ও ইসলামের সমুজ্জ্বল নিদর্শন। ইবাদত বন্দেগী ও কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারের প্রাণ কেন্দ্র। মসজিদের সযত্ন তত্ত্বাবধান সুষ্ঠু সুন্দরভাবে উত্তমরূপে পরিচালনা মু’মিনের দায়িত্ব। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তারাই তো আল্লাহর মসজিদ সমূহ রক্ষণা বেক্ষণ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও পরকালের উপর এবং নামায কায়েম করে যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেনা সুতরাং এটাই সন্নিকটে যে, এ সব লোক সৎ পথ প্রাপ্তদের অন্তর্র্ভূক্ত হবে। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ১৮)
মসজিদের জন্য “ইযনে আম” অর্থাৎ সর্ব সাধারণের প্রবেশাধিকারের অনুমতি শর্ত। আদম আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে প্রেরিত হয়ে বসবাসের ঘর নির্মাণের পূর্বে বায়তুল্লাহ ইবাদতের জন্য আল্লাহর ঘর নির্মাণে আদিষ্ট হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্ব প্রথম যে ঘর স্থাপিত হয়েছিল তা মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় ও বিশ্ব জগতের দিশারী। (সূরা: আলে ইমরান, ৩:৯৬)
হিজরতের পর প্রথমে মসজিদ নির্মাণ: হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে কুবায় অবস্থান করেন সেখানে নবীজি মসজিদ নির্মানের উদ্দেশ্যে হযরত কুলসুম বিন হাদাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর একটি জমি পছন্দ করেন। এখানে নূর নবীজির নূরানী হাতে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন এটি মসজিদে কুবা নামে প্রসিদ্ধ। এই মসজিদের গুরুত্ব ও প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নি:সন্দেহে সেই মসজিদ যার ভিত্তি প্রথম দিন হতেই তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত, আপনি দাঁড়ানোর জন্য সেটাই অধিক উপযূক্ত সেখানে এমন লোকেরা আছে যারা অতি পবিত্রতা লাভ করতে ভালোবাসে এবং আল্লাহ পবিত্রতা অর্জন কারীদের ভালোবাসেন। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ১০৮, সীরাতুল মুস্তফা কৃত: আল্লামা আবদুল মুস্তফা আযমী, পৃ: ১৪২)
অত:পর নবীজি মদীনায় এসে মসজিদে নির্মানের গুরুত্ব অনুধাবন করলেন, নবীজির আবাসস্থলের পাশেই বনু নাজ্জার গোত্রের একটি বাগান ছিল, নবীজি মসজিদ নির্মানের জন্য বাগানের জায়গাটি অর্থ মূল্য দিয়ে ক্রয় করার প্রস্তাব দেন, নবীজির ভালোবাসায় বিনামূল্যে জায়গাটি নবীজিকে অর্পন করতে সম্মত হলেও যেহেতু এ বাগানে আরো দুজন ইয়াতীমের মালিকানা ছিল এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সম্পদ থেকে দুই ইয়াতিমের মূল্য পরিশোধ করে দেন। (মাদারেজুন নবুওয়াত, খ: ২ পৃ. ৬৮, সীরাতুল মুস্তাফা, পৃ: ১৪৬)
মসজিদ আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় স্থান: মুসলিম জাতির সামাজিক ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মসজিদের গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম মসজিদই ছিল মুসলিম জাতির নৈতিক চরিত্র গঠন, সমাজ সংস্কার, সংশোধন ও ইসলামের আলো বিকিরণের কেন্দ্র বিন্দু। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলার নিকট স্থান সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রিয় স্থান মসজিদসমূহ এবং সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য স্থান বাজার সমূহ। (মুসলিম শরীফ, ১ম: খন্ড, হাদীস: ৬৭১)
বর্ণিত হাদীসের প্রকৃত তাৎপর্য হলো মুসলিমরা যেন মসজিদের সাথে অধিকতর সম্পর্ক রাখে, আল্লাহর রহমত নিয়ামত বরকত লাভের উদ্দেশে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ইবাদত বন্দেগী ও আল্লাহর স্মরণ ও তাকওয়া অর্জনের উৎকৃষ্ট স্থান হিসেবে বান্দা যেন মসজিদ কে অত্যাধিক গুরুত্ব দেয়। পক্ষান্তরে বাজার মার্কেট বর্তমান সময়ের আধুনিক শপিংমলগুলোতে নারী পূরুষের অবাধ বিচরণ। শটতা কপটতা মিথ্যাচার পাপাচার দুর্নীতি প্রতারণা বিশ্বাসঘাতকতা ও পাপ পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত বাজার সমূহ বর্তমানে চরমভাবে কলুষিত। কেবলমাত্র প্রয়োজনের নিমিত্তে বাজারে গমন করবে শরয়ী সীমা রেখায় থেকে বাজারে গিয়ে সৎ ন্যায় পরায়ন আদর্শ ব্যবসায়ীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে লেন দেন সীমিত রাখবে। অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফাখোর ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অনৈতিক ও শরীয়ত গর্হিত কর্মকাণ্ড থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে।
মসজিদ নির্মাণের ফযীলত: একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণ করবে তাঁর জন্য সুসংবাদ রয়েছে। লৌকিকতা প্রদর্শন, নিজের সুনাম ও খ্যাতির জন্য নয়, নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, কেবলমাত্র আল্লাহর রেজামন্দি অর্জনের প্রত্যয়ে যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণ করবে তার জন্য রয়েছে পরকালে উত্তম প্রতিদান ও সুসংবাদ। এরশাদ হয়েছে, “হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। (সহীহ মুসলিম, খন্ড:১ম, পৃ: ২০১)
মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা নিষেধ: দুনিয়াবী স্বার্থ, ব্যক্তি স্বার্থ, পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য মসজিদে কথা বার্তা বলা নিষেধ। যে আলোচনায় দ্বীনি কল্যাণ নেই, দ্বীনি আদর্শ ও চেতনা জাগ্রত করার আহবান নেই, সততা ও ন্যায়নীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের শিক্ষা নেই, এমন অনর্থক অর্থহীন ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষা বিবর্জিত আলোচনা করা ও মসজিদে প্রবেশ করে পরস্পর হাসি তামাশা ও আনন্দ বিনোদন মূলক খোশ গল্পে মত্ত হওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মুরসাল সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মানুষের সামনে এমন একটা যুগ আসবে যে তাদের পার্থিব কথা বার্তা মসজিদগুলোতে হবে। তোমরা তাদের মজলিসে বসবেনা। আল্লাহর এমন লোকদের প্রয়োজন নেই। (শুয়াবুল ঈমান, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৩৮৭, হাদীস: ২৭০১)
বর্ণিত হাদীসে দুনিয়াবি কথা বার্তার শর্তারোপ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, মসজিদে দ্বীনি কথাবার্তা বলা জায়েজ। হাদীসবেত্তাদের বর্ণনা মতে মসজিদে দুনিয়াবি কথা বার্তা দ্বারা বান্দার নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। বান্দা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে, আল্লাহর নিকট এমন লোকদের কোন গুরুত্ব ও প্রয়োজন নেই। (মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, খন্ড:১ম, পৃ: ৫২৪)
মসজিদে দুনিয়াবী স্বার্থে কথাবার্তা বলা, পার্থিব স্বার্থে আলোচনাকারী লোকদের উপর আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট। (আশি আতুল লুম’আত, খন্ড: ১ম, পৃ: ৩৩৯)
মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলার উদ্দ্যেশে উপস্থিত হওয়া ও অবস্থান করা হারাম। এতে বান্দার নেক আমল এমনভাবে বিনষ্ট হয় যেভাবে আগুন লাকড়ীকে ভস্মীভুত করে। কথাগুলো যদি অশ্লীল ও অশালীন হয় তা হবে আরো কঠোর হারাম যা হবে কঠোর শাস্তির কারণ। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়্যাহ, খন্ড: ৬, পৃ: ৪২০)
মসজিদে মুবাহ কথা বলাও জায়েজ নেই, আওয়াজ উচ্চ করাও জায়েজ নেই। (দুররুল মোখতার, ছগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৩, পৃ: ২৮৪)
মক্কা শরীফের মসজিদে হেরম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মসজিদ অত:পর মসজিদে নববী, অত:পর ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদুল আকসা, অত:পর মসজিদে ক্বোবা, অত:পর জামে মসজিদ সমূহ, অত:পর গ্রামের মসজিদ অত:পর সড়কের মসজিদ। রদ্দুল মুখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৩, পৃ: ২৮৫)
ক্রয় বিক্রয় এবং প্রত্যেক প্রকার বিনিময় চুক্তি মসজিদে নিষিদ্ধ, শুধুমাত্র ইতিকাফ পালন কারীর জন্য অনুমতি রয়েছে যদি ব্যবসার জন্য ক্রয় বিক্রয় না করে বরং নিজের এবং সন্তান সন্তুতির প্রয়োজনে এবং বস্তু যদি মসজিদে নিয়ে আসা না হয় তখন জায়েজ হবে। (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৩, পৃ: ২৮৪)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে মসজিদের পবিত্রতা ও আদব রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
আবদুল কাইয়ুম
পূর্ব জোয়ারা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম
প্রশ্ন: মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া ও ভিক্ষা দেওয়া জায়েজ আছে কিনা? এ প্রসঙ্গে ইসলামী সমাধান জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: কোনো ব্যক্তি মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া হারাম এবং তাকে ভিক্ষা দেওয়াও মাকরূহ। দুররুল মোখতার প্রণেতা আল্লামা ফকীহ আলাউদ্দিন হাসকফী বর্ণনা করেন, মসজিদে সাহায্য চাওয়া ভিক্ষা চাওয়া হারাম, ভিক্ষা প্রদান করা মাকরূহ, মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া থেকে বিরত থাকবে, যিনি ভিক্ষা প্রদান করতে চান তিনি মসজিদে বাইরে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা দেওয়া জায়েজ। [ফাতওয়ায়ে শামী, পৃ: ৪৮৮, ওয়াকারুল ফাতওয়া, খন্ড: ২, পৃ: ২৬২ কৃত আল্লামা মুফতি ওয়াকার উদ্দিন বেরলভী (র.)]
সদরুশ শরীয়ত আল্লামা মুফতি আমজাদ আলী (র.) বর্ণনা করেন, মসজিদে ভিক্ষা চাওয়া হারাম এবং ভিক্ষুককে দান করা নিষিদ্ধ। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৩, পৃ: ২৮৩)
আ’লা হযরত বর্ননা করেন, যারা মসজিদে ভিক্ষুককে একটি পয়সা দান করবে তাকে আল্লাহর রাস্তায় আরো সত্তর পয়সা দিতে হবে, যেন এ পয়সা গুণাহের কাফফারা হয়ে যায়। তবে গর্দান না ডিঙ্গিয়ে কারো নামাযের ক্ষতি না করে কোন অভাবী ব্যক্তিকে সাহায্যের আহ্বান করা বা কোন দ্বীনি কর্মকাণ্ডে সাহায্যে দান করার বৈধতা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুসহ অসংখ্য সাহাবীগণের বর্ণিত, হাদীস দ্বারা প্রমানিত। (আহকামে শরীয়ত, খন্ড: ১, পৃ: ১১১)