মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণে নিমিষেই গুঁড়িয়ে যাচ্ছে বহুতল ভবনগুলো। চোখের সামনেই জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো প্রাণ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে গাজা উপত্যকার প্রাসাদগুলো। হ্যাঁ বলছিলাম বর্বর ইহুদিদের নির্বিচার গোলাবর্ষণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। অসহায় পিতা–মাতার সামনে নিজ সন্তানের করুণ মৃত্যু–সে এক ভয়াল অবস্থা। কংক্রিট এর নিচে চাপা পড়া অবুঝ শিশুদের বের করে আনা পিতার এক কষ্টসাধ্য আর্তনাদ পৃথিবীর আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। অন্ধকার ধোঁয়াশায় নিপতিত ফিলিস্তিনের আকাশ। গাজাবাসীদের চোখে ঘুম নেই–খোলা আকাশের নিচে তাদের অবস্থান। এতেও যেন শান্তি নেই–কখন যেন আবার গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েল হানাদার বাহিনী। তছনছ করে দেবে তাদের জীবনের আয়োজন। আর এটাই চলছে গত ২০ দিন ধরে গাজাবাসীদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
এখনো পৃথিবীর মানুষ জানে না এই হত্যাযজ্ঞ আর কতদিন চলবে? বিশ্ব নেতারা বিবৃতি পাল্টা বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এটির নিরসনে কার্যতঃ কোন পদক্ষেপ কেউ দেখছে না। বিশ্ব মুসলিম নেতারা যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। নিরপরাধ মাসুম বাচ্চারা যেভাবে মারা যাচ্ছে তা মিডিয়ার কল্যাণে যেভাবে আসছে তা দেখে শরীরের লোম যেন খাড়া হয়ে উঠে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় মানবতা। কোথায় আজ মানবাধিকার? ডান্ডাবেড়ি পরে যেন হাঁটছে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। এই শক্তিধর দেশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বর্বর ইসরায়েল বাহিনী যেন দুর্দন্ড প্রতাপে তাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে আরও সাহস পাচ্ছে। জাতিসংঘে সামান্য বিরোধীতার কারণে বর্বর ইসরায়েল তাদের সাথে বাক বিতন্ডায় জড়িয়েছে। এদিকে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস তাদের নিজস্ব অধিকার ফিরিয়ে নিতে এবং নিজস্ব ভূমি রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। ৭৫ বছর ধরে যে দুঃশাসন, নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ ইসরায়েল বাহিনী মজলুম ফিলিস্তিনিদের উপর চালিয়ে আসছে তার জবাব শুধু ইট–পাথরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এভাবে মার খেতে খেতে যখন ফিলিস্তিনিবাসীর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে তখন আত্নরক্ষার কৌশল হিসাবে কিংবা নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে হামাস সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়। তাদের সাথে শক্তিধর ইসরায়েলের যুদ্ধ চলছে দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে–যেমনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিকামী বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছিল ৯ মাস ধরে নিজ মাতৃভূমি উদ্ধারের লড়াইয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্নাহুতির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য এনেছিল এদেশের দামাল সন্তানেরা। স্বাধীকার ফিরে পেয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগণ। তেমনিভাবে আজ অসহায় ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছে হামাস নামক মুক্তিকামী সংগঠন। এই বর্বর ইহুদিদের বসতিস্থল ছিল না, তাদেরকে থাকার সুযোগ করে দিয়ে ফিলিস্তিনবাসী যে উদারতা দেখিয়েছে তার করুণ খেসারত দিতে হচ্ছে আজ। কথায় কথায় ফিলিস্তিনিবাসীদের উপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব মুসলিমদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আল আকসার ভেতরে প্রবেশ করে অসংখ্য মুসল্লিকে এ পর্যন্ত শহীদ করেছে ইসরায়েল বাহিনী আর আহত করেছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। এই পবিত্র মসজিদকে রক্ষা করার দৃপ্ত শপথ নিয়ে তারা ব্যুহ রচনা করেছিল বারবার কিন্তু বর্বর ইহুদিদের কবল থেকে এই পবিত্র মসজিদটি রক্ষা পাচ্ছে না। কারণ এটার সাথে জড়িত রয়েছে অনেকগুলো স্মৃতি, স্মৃতি বিজড়িত এই পবিত্র মসজিদ বিশ্ব মুসলিমের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। কারণ এখানেই বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর ইমামতিতে সোয়া লক্ষ পয়গম্বর নামাজ আদায় করেছিলেন মেরাজে গমনের আগ মুহূর্তে, ‘মহিমান্বিত (আল্লাহতায়ালা), যিনি তার বান্দাকে রাতের বেলায় মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসায় নিয়ে গেলেন, যার পারিপার্শ্বিকতাকে আমি (আগেই) বরকতপূর্ণ করে রেখেছিলাম, (উদ্দেশ্য ছিল) আমি যেন তাকে আমার (দৃশ্য ও অদৃশ্য) কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি; অবশ্যই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ’–সূরা বনী ইসরাঈল–০১। এটি বিশ্ব মুসলিমদের প্রথম কেবলা। এখানেই হযরত সোলাইমান (আঃ) এর নির্দেশে জ্বীনেরা গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে বড় বড় পাথর এনে এই মসজিদ নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন। হযরত জীবরাঈল (আঃ) এর জন্মস্থান এই ফিলিস্তিন। অনেকগুলো নবী–রাসূল এর জন্ম হয়েছে এই পবিত্র ভূমিতে। তাই এটি রক্ষায় অমূল্য জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনবাসী। এতদিন ধরে আকাশ থেকে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল বাহিনী। এখন স্থলপথে অভিযান শুরু করেছে–এতে লাশের সারি লম্বা হচ্ছে। আহতদের আর্তনাদে আকাশ ভারী হয়ে উঠছে–চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। লাশের গন্ধে বিভিষীকাময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে গাজার অলিতে গলিতে। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে শিশু আর নারীরা। এখনো ৮০০ শিশু ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে আছে। প্রতিদিন গাজার বিভিন্ন শহরে নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করছে ইসরায়েল বাহিনী। ইসরায়েলের নির্মম হামলায় গাজার প্রান্তে প্রান্তে এখন স্বজন হারানোর মাতম। উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে আড়াই মাস বয়সী ছেলেকে হারিয়ে এক বাবার আহাজারি ছিল এই রকম, ‘ও কি কাউকে মেরেছে? অপহরণ করেছে? নিষ্পাপ শিশুগুলো বাসার মধ্যেই ছিল। তাদের দোষ কি?’ ইসরায়েলের গোলার আঘাতে তার স্ত্রী ও ৩ সন্তান মারা গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের অব্যাহত বোমা হামলায় গত ২০ দিনে ৭,০২৮ জন নিহত হয়েছে–তাদের মধ্যে শিশু ২,৯১৩ জন, নারী ১৭০৯ জন, বৃদ্ধ ৩৯৭ জন। অবিরাম বোমা বর্ষণে ২ লাখ বাড়ি ও ফ্ল্যাট ধ্বংস হয়েছে। গাজার ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। মারা গেছে ১০১ স্বাস্থ্যকর্মী। গাজার কোন স্থান এখন নিরাপদ নয়। তুরুস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তায়েফ এরদোয়ান বলেছেন– এই হামলা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম বর্বরতা। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা বলেছেন– গাজায় যুদ্ধ নয়, গণহত্যা চলছে। এত বিপুল সংখ্যক মরদেহ হাসপাতালের হিমঘরে রাখার জায়গাও নেই। গাজার সব হাসপাতালের চিত্র একই রকম। একজন চিকিৎসক বলেন– যদি এই সংঘাত চলতে থাকে তাহলে মানুষকে দাফন করার জায়গাও থাকবে না। বিদ্যুৎ, জ্বালানী, পানি, খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে গাজার মানুষ। আর এই মানবতার অবস্থার মধ্যেও দীর্ঘদিন ধরে ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকতে না দেওয়ায় আরও করুণ দশার সৃষ্টি হয়েছে গাজার মানুষদের মাঝে। সর্বত্র হাহাকার অবস্থা, করুণ চিত্র, আল্লাহর আরশ যেন কাঁপছে। দীর্ঘদিন ধরে মহান আল্লাহতায়ালা গাজার স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপর পরীক্ষার উপর পরীক্ষা আরোপ করছেন। আর এই প্রতিটি পরীক্ষায় তারা সফলভাবে উত্তীর্ণ হচ্ছে, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো, ভয়–ভীতি, ক্ষুধা–অনাহার, জান–মাল ও ফসলাদির ক্ষতিসাধন করে (তোমাদের পরীক্ষা করা হবে, যারা ধৈর্যের সাথে এর মোকাবেলা করে); তুমি ধৈর্যশীলদের (জান্নাতের) সু–সংবাদ দান কর’– সূরা বাকারা–১৫৫। মাত্র ৭৪টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে গাজায়, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। সংঘাতের আগে প্রতিদিন গাজা উপত্যকাটিতে গড়ে ৪৫০ ট্রাক ত্রাণ সহায়তা যেত–এ যেন মরার উপর খরার ঘা। এই অমানবিক পরিস্থিতি চলতে থাকলে ইসরায়েল–ফিলিস্তিনির সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পরার আশংকা দেখা দিয়েছে। এখনই এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা দরকার। মুসলিম বিশ্বে ৫৭ টি রাষ্ট্র থাকা সত্বেও তারা যেন নির্বিকার, চুপ। আজ ৮০ লক্ষ ইহুদির সামনে ২০০ কোটি মুসলিম যেন অসহায়। তাদের বোবা কান্নায় আল্লাহর আরশ যেন কাঁপছে। অবশ্যই আল্লাহতায়ালার সাহায্য আসবে। আমীন।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল