দেশের জ্বালানি তেলের একমাত্র শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট অবশেষে আলোর মুখ দেখছে। সরকার এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয় অর্থের ৭০ শতাংশ যোগান দিতে রাজি হয়েছে। এতে করে অর্থ সংকটে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্পটি নতুন গতিশীলতায় অগ্রসর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন প্রকল্পটি আর্থিক সংকটে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। শুরুতে প্রকল্পটির পুরো ব্যয় বিপিসি থেকে যোগান দেয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে তা আর হয়ে উঠেনি। আর্থিক সংকটে বিপিসি নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসে।
অপরদিক ফ্রান্সের টেকনিপ নামের কোম্পানি এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেয়ার একটি কথাবার্তাও চলছিল। শেষতক তাও হয়নি। টেকনিপ ‘না’ করায় প্রকল্পটির ভবিষ্যত নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এদিকে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ে প্রকল্পটি দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বিশেষ করে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের বহুমুখী সুবিধা এবং সংকট তৈরি হলেও বাংলাদেশ পরিশোধন সক্ষমতা না থাকায় এর কোনটিই গ্রহণ করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের পতেঙ্গাস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল এই রিফাইনারিতে পরিশোধন করে দেশের চাহিদা মেটাতে যোগান দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে নির্মিত দেশের একমাত্র রিফাইনারিটি এখনো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হয়ে রয়েছে। দেশে ৫৫ লাখ টনেরও বেশি জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগই আমদানি করা হয় পরিশোধিত অবস্থায়। ক্রুড অয়েল থেকে রিফাইনড অয়েলের মূল্য বেশ চড়া। এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেতো। কিন্তু ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় দেশে ক্রুড অয়েল আমদানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় বাড়তি অর্থ ব্যয় করে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এই বাড়তি খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০১০ সালে দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি–২ নামে নতুন একটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ২শ’ একর জায়গার একপাশের ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের কথা। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার ১৩ বছর গত হলেও প্রকল্পটির কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার কোটিরও বেশি বেড়ে গিয়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার স্থলে ২৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকায় ঠেকেছে।
সূত্র বলেছে, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন নানাভাবে এই প্রকল্পের অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। কিন্তু কোনভাবেই তা সম্ভব হয়নি। বিপিসি নিজস্ব তহবিল থেকে পুরো অর্থের যোগান দেয়ার আশা নিয়ে মাঠে নামলেও শেষতক আর পারেনি।
নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে মাস কয়েক আগে বিপিসি সরকারের নিকট ভিন্ন ধরণের একটি প্রস্তাব দেয়। প্রকল্পটির গুরুত্ব তুলে ধরে বিপিসির পক্ষ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ যোগান দেয়ার প্রস্তাব করে বাকি ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের তহবিল থেকে যোগান দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দেখা করেও বিপিসির পক্ষ থেকে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা করা হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। অবশেষে সরকার এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশ অর্থ যোগান দিতে সম্মত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পাওয়া গেছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় সর্বমোট ২৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকার মধ্যে বিপিসি নিজস্ব তহবিল থেকে ৬ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা যোগান দেবে। প্রকল্পের বাকি ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকার যোগান দেয়া হবে অর্থ বিভাগ থেকে। ২০ বছরের জন্য এই টাকা ঋণ হিসেবে প্রদান করা হবে। বিপিসি ৫ শতাংশ সুদে এই টাকা পরিশোধ করবে। ইস্টার্ন রিফাইনারির আয় থেকেই এই টাকা খুব সহজে সরকারকে পরিশোধ করা সম্ভব হবে বলে গতকাল বিপিসির পদস্থ একজন কর্মকর্তা জানান।
তিনি বলেন, প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিপিসি শত শত কোটি টাকা আয় করতে পারবে। যা থেকে খুব সহজেই সরকারের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ১৭ ধরণের পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট উৎপাদন করা হয় বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে উন্নতমানের বিটুমিন, এলপিজি, জেট ফুয়েলসহ নানা ধরণের পণ্য আমদানিখাতে বর্তমানে যে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে তার একটি বড় অংশই ইস্টার্ন রিফাইনারির সেকেন্ড ইউনিট রক্ষা করবে। বার্ষিক ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা সম্পন্ন এই প্রকল্পটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার অনেক বড় অবলম্বন হয়ে উঠবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।