বাসে অগ্নিসংযোগ ভাঙচুরসহ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে বিএনপির আহুত অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ছিল কর্মসূচির প্রথম দিন। এদিন ভোরে ইপিজেড থানা এলাকায় যাত্রী বেশে একটি বাসে দুই যুবক আগুন দেয়। পরে সাড়ে ৯টার দিকে আকবর শাহ থানার পাক্কা রাস্তার মাথা এলাকায় অবরোধের সমর্থনে বের হওয়া মিছিল থেকে ৮–১০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এছাড়া কয়েক জায়গায় অবরোধের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল করা ছাড়া দিনভর আর কোথাও ‘নাশকতা’র খবর পাওয়া যায়নি। অবরোধ চলকালে সকালে নগরে যানবাহনের সংখ্যা ছিল কম। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে গণপরিবহনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এছাড়া দিনভর বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা না গেলেও ‘শান্তি সমাবেশ’ করে মোড়ে মোড়ে অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের। এদিকে গতকাল নগর থেকে ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার কোনো বাস। এতে পরিবহন সংকট তৈরি হয় ঢাকা–চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে। তবে শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন ছেড়ে গেছে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাভার্ড ভ্যান ও মালবাহী ট্রাক চলাচল করেছে। নাশকতা রোধে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত টহলে ছিল বিজিবি ও পুলিশ। অবরোধ চলাকালে স্বাভাবিক ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য উঠানামা। পণ্য খালাসের পর পরিবহনও ছিল স্বাভাবিক। খোলা ছিল দোকানপাট, সরকারি–বেসরকারি অফিস, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। খোলা ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।
নগরে ২ বাসে আগুন : গতকাল সকাল ৬টার দিকে নগরের ইপিজেড থানার সিমেন্স হোস্টেল এলাকায় একটি বাসে যাত্রীবেশে উঠে আগুন দেয় দুর্বত্তরা। পোশাক শ্রমিকদের নেওয়ার জন্য বাসটি সেখানে দাঁড়িয়েছিল। এ সময় যাত্রীবেশে বাসের ভেতরে থাকা দুই জন আগুন ধরিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে বলে বাসটির চালকের বরাত দিয়ে জানায় পুলিশ। এর আগে ধুপখোলা থেকে বাসটি বের করে ইপিজেড যাওয়ার পথে ওই দুই যুবক যাত্রীর পরিচয় দিয়ে বাসটিতে উঠে। এ ঘটনায় কেউ হতাহত নেই। এদিকে আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশেনের অপারেটর জানায়, খবর পেয়ে প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি। জড়িতদের শনাক্তে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা যাচাই–বাছাই করছি। যেহেতু গার্মেন্টস টাইম, সেখানে অনেক লোকই ছিল।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার বালুচরা ট্যানারি বটতলা এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসেও আগুন দেয় দুর্বুত্তরা। বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি ফেরদৌস জাহান জানান, ট্যানারি বটতল হাশেমী মাদ্রাসা গেইটের বিপরীত দিকের রাস্তার পাশে খালি বাসটি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাসটিতে আগুন দেয় দুবৃর্ত্তরা।
বিজিবির টহল : ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড থেকে মীরসরাই পর্যন্ত অংশে গতকাল টহল দেয় বর্ডার গার্ড ব্যাটেলিয়ন (বিজিবি)। অবশ্য সোমবার রাত ৯টা থেকে বিজিবির টহল শুরু হয়।
৮ ব্যাটেলিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সাংবাদিকদের জানান, সীতাকুণ্ড ও মীরসরাইয়ে দুই প্লাটুন করে মোট চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতি প্লাটুনের সদস্যরা চারটি করে মোট আটটি টিমে ভাগ হয়ে টহল দিচ্ছে।
গ্রেপ্তার ও ককটেল উদ্ধার : অবরোধের শুরুতে সকালে আকবর শাহ থানার পাক্কা রাস্তার মাথা এলাকায় অবরোধের সমর্থনে যৌথ মিছিল বেল করে নগর ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। এ সময় তারা চট্টগ্রামমুখী ৮ থেকে থেকে ১০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন। খবর পেয়ে পেয়ে আকবর শাহ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাদের ধাওয়া করে। শুরুতে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলেও ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায় অবরোধকারীরা। এসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম শহীদসহ কয়েকজন আহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ১৪ জনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি কালো ব্যাগভর্তি অবিস্ফোরিত সাতটি ককটেল উদ্ধার করা হয় বলে জানায় পুলিশ।
আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়ালিউদ্দিন আকবর বলেন, বিএনপিও অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতা–কর্মী সিটি গেইটস্থ মহাসড়কের পাক্কা রাস্তার মাথা এলাকায় অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করেন। একপর্যায়ে তারা সড়কে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করেন। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে ধাওয়া দিয়ে ১৪ জনকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাক্কা রাস্তার মাথা এলাকার মহাসড়কের পাশে একটি কালো ব্যাগভর্তি অবিস্ফোরিত সাতটি ককটেল উদ্ধার করা হয়। তবে ঘটনাস্থল থেকে কাউকে আটক করা যায়নি। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
নগর পুলিশের পাহাড়তলী জোনের সহকারি কমিশনার মো. মাইনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে খবর ছিল পাকা রাস্তার মাথাসহ আশপাশের এলাকায় অবরোধকারীরা নাশকতা করতে পারে। এ জন্য আমরা টহল দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমরা দেখতে পাই, পাকা রাস্তার মাথা এলাকায় ঝটিকা মিছিল বের করে আনুমানিক ৭০–৮০ জন লোক পণ্যবাহী বিভিন্ন ট্রাক ভাংচুর করছে। আমরা দ্রুত গিয়ে তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দিই।
নগর বিএনপি’র দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইদ্রিস আলী আজাদীকে বলেন, অবরোধের সমর্থনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রবেশপথ অবরুদ্ধ করে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সমাবেশ হয়েছে। সিটি গেইটসহ বিভিন্ন প্রবেশপথে মহানগর বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলসহ অঙ্গসংগঠনের শত শত নেতাকর্মী অবস্থান নেন। তবে এসময় পুলিশ বিভিন্নস্থানে বিএনপির শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা ও গ্রেপ্তার নির্যাতন চালিয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৫ জন নেতাকর্মীকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে যে ককটেল উদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে তা সাজানো নাটক। বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ ককটেল উদ্ধারের সাজানো ঘটনা ঘটিয়েছে।
ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থা : আমাদের সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, সকালে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে দেখা গেছে, মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেনে কাভার্ড ভ্যান ও মালবাহী ট্রাক চলাচল করছে। ব্যক্তিগত গাড়ি তেমন একটা দেখা যায়নি। দূরপাল্লার কোনো যানবাহনও চলাচল করেনি। সড়কে পর্যাপ্ত ছোট যানবাহন চলাচল করায় স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের চলাচলে তেমন অসুবিধা হয়নি। এ সময় সড়কে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়। তবে মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা অবস্থান নিলেও বিএনপি–জামায়াতের উপস্থিতি চোখে পড়েনি কোথাও।
আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়সহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়া পদত্যাগপত্র জমা দেয়া সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য আ ম ম দিলসাদসহ আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে অবস্থান নেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে এম রফিকুল ইসলাম জানান, সোমবার রাত থেকে তার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন বিজিবি সদস্য নাশকতা ঠেকাতে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে অবস্থান নেন।
আমাদের মীরসরাই প্রতিনিধি জানান, সকাল থেকে দিনভর দূরপাল্লার গণপরিবহন শূন্য ছিল দেশের ব্যস্ততম ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, দু–এক মিনিট পর পর পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি, সেফ লাইন ইত্যাদি চলতে দেখা গেছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে অফিসমুখী লোকজনকে। অনেকে বাস না পেয়ে লেগুনা ও সিএনজি চালিত অটোরিকশাযোগে গন্থব্যে গেছেন। সড়কের মীরসরাইয়ের ধুমঘাট থেকে সীতাকুণ্ডের সিটি গেইট পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার এলাকায় মানুষের ভরসা ছোট লেগুনা পরিবহন।
সিটি গেইট থেকে মীরসরাই সদরে আসা ব্যাংকার ফাউজুল কবির বলেন, সিটি গেইট থেকে প্রতিদিন বাসে ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে মীরসরাই আসি। আজ (গতকাল) বাস না থাকায় বাধ্য হয়ে লেগুনাতে ২৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে আসতে হয়েছে। ভাড়া যেমন বেশি গুণতে হল সময়ও বেশি লেগেছে।
এদিকে যে কোনো ‘নাশকতা’ ঠেকাতে মোকাবেলায় ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেল রুটের মীরসরাই উপজেলা এলাকার ১৮টি স্থানকে শনাক্ত করে বিজিবি টহল দেয়া শুরু করা হয়েছে। টহল দেয় পুলিশও।
মীরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন বলেন, রামগড় ও চট্টগ্রাম ব্যাটালিয়ন থেকে ২ প্লাটুন করে ৪ প্লাটুন বিজিবি মীরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানায় মোতায়েন করা হয়েছে। আগামী তিন দিন অবরোধে মহাসড়কে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে পুলিশের সাথে সমন্বয় করে কাজ করবে। জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদ হোসেন বলেন, যে কোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে পুলিশ ডিউটি করছে। এখনো পর্যন্ত কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মীরসরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন জণগণের নিরাপত্তায় যে কোনো তথ্য দিয়ে উপজেলা প্রশাসনের পাশে থাকার আহ্বান জানান।