কর্ণফুলীর তলদেশে স্বপ্নের টানেল চালু হওয়ার একদিনের মাথায় গাড়ি নিয়ে কিছু তরুণের অ্যাডভেঞ্চারে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত স্পোর্টস কার নিয়ে তারা হলিউডের ‘ফাস্ট এন্ড দ্য ফিউরিয়াস’ সিনেমার আদলে রেস তৈরি করে টানেল এবং টোল প্লাজায়। এতে ঘটতে পারতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা। নিজেদের গাড়ির রেসের ভিডিও ধারণ করে তা নিজেদের ‘দ্য স্লো কিডস’ নামের একটি ফেসবুক পেজেও পোস্ট করে তারা। এ তরুণেরা কোনো ধরনের নিয়ম শৃঙ্খলা না মেনেই টানেলের ভিতরে এবং টোল প্লাজায় বেপরোয়া গতির ঝড় তোলে। তাদের গাড়িগুলোর কয়েকটিতে ইচ্ছেমতো ইঞ্জিন এবং সাইলেন্সার বসিয়ে গাড়ির অবয়ব চেঞ্জ করা হয়েছে। দেশের প্রথম শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে কর্ণফুলীর তলদেশের বঙ্গবন্ধু টানেল সর্বাধিক নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা থাকলেও এরা কিভাবে যে টানেলের ভিতরে এবং টোল প্লাজার সামনে এমন ঝড় তুললো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত শনিবারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করার পর গত রোববার ভোর ৬টা থেকে সর্বসাধারণের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় টানেল। দিনভর নির্ঝঞ্ঝাটে টানেলে গাড়ি চলে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে, মধ্যরাতের পর একইসাথে ১০/১২টি প্রাইভেট কার নিয়ে আসে একদল যুবক। তারা গাড়ি নিয়ে টানেলের ভিতরে প্রবেশ করে। টানেলে প্রবেশের পর থেকে তারা তাদের গাড়িগুলো নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করে, ঝড় তোলে গতির। সাইলেন্সার পাইপে বিকট শব্দ তোলে গাড়িগুলো এলেমেলো ছুটতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ভিডিও দেখে অনুমান করা যায় একশ কিলোমিটারের বেশি গতিতে তারা ছোটাছুটি করছিল। টানেলের ভিতরে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তাদের গতি ছিল অনেক বেশি।
গাড়িগুলো টানেল থেকে টোল দিয়ে বের হওয়ার পর টোল প্লাজার সামনে ড্রিফটিং করে আবারো নানাভাবে আতঙ্ক ছড়ায়। এক একটি গাড়ি একই জায়গায় চরকির মতো ঘুরতে থাকে। গাড়ি নিয়ে সিনেমায় কিংবা সার্কাসে যেভাবে খেলা দেখানো হয় তেমন করে নানা কসরত করা হচ্ছিল দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিতরে এবং টোল প্লাজার সামনে। বিষয়টিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং বেপরোয়া মানসিকতার বখাটেপনা বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার মধ্যরাতের পর ১০টির মতো গাড়ি বেপরোয়া গতি নিয়ে টানেলে প্রবেশ করে। এর মধ্যে কয়েকটি দামি স্পোর্টস কারের পাশাপাশি একাধিক পুরাতন গাড়িও রয়েছে। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করেও গাড়িগুলোর বেআইনী তৎপরতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যেগুলোতে অবৈধভাবে ইঞ্জিন পরিবর্তন এবং মোডিফাই করা হয়েছে। ‘খ’ সিরিজের একটি গাড়িতে এক হাজার থেকে বারোশ’ সিসির ইঞ্জিন থাকে। ১২শ’ সিসির ইঞ্জিনে এমন গতির ঝড় তোলা সম্ভব নয়। অথচ টানেলের অভ্যন্তরে গতির ঝড় তোলা হয়েছে। ভিডিও ধারণ করা হয় লালরঙের একটি গাড়ি থেকে। ওই গাড়িটি ঢাকা মেট্রো-‘খ’ সিরিজের। এই গাড়িতে সর্বোচ্চ ১২শ’ সিসি’র ইঞ্জিন থাকার কথা। কিন্তু গাড়িটিতে বেশি ক্ষমতার ইঞ্জিন অবৈধভাবে স্থাপনের পাশাপাশি গাড়ি মূল আদলও চেঞ্জ করে ফেলা হয়েছে।
এক একটি গাড়ি যেভাবে গতির ঝড় তোলে টানেলের ভিতরে ছুটছিল তাতে যে কোনো সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। এই ধরণের দুর্ঘটনায় একই সাথে ১০/২০ গাড়ি পর্যন্ত দুর্ঘটনার শিকার হয়। এই ধরণের ঘটনায় গাড়িতে আগুন ধরে সদ্য চালু করা টানেলে বড় ধরণের বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতো। টোল প্লাজার সামনে যেভাবে গাড়িগুলো চরকির মতো ঘুরছিল তাতেও বড় ধরণের অঘটনের আশংকা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, গাড়ি নিয়ে বেপরোয়া গতি তোলা যুবকেরা চট্টগ্রামের। নগরীর চট্টেশ্বরী রোড, সিআরবি এবং লিংক রোডেও তারা গতির ঝড় তোলে। ধণার্ঢ্য পরিবারের কিছু যুবক এই ধরণের বেপরোয়া গাড়ি চালায়। তারা নগরীর খুলশী আবাসিক এলাকার ভিতরেও প্রায়শঃ গতির ঝড় তোলে। এদের ঠেকাতে খুলশী আবাসিক এলাকার প্রতিটি রাস্তায় বড় বড় স্পিডব্রেকার বানানো হয়েছে।
রোববার গভীর রাতে টানেলের ভিতরে বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের ভিডিও গতকাল দৈনিক আজাদীর অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হলে হৈ চৈ পড়ে যায়। চারদিক থেকে বিষয়টি নিয়ে নিন্দা ও ক্ষোভ জানানো হয়। এদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে কঠোর শাস্তির আওতায় আনারও দাবি জানানো হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আজাদীর পক্ষ থেকে যে গাড়ি থেকে ভিডিওটি করা হয় সেই গাড়ির চালক আশরাফুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি পুরো ভিডিওটিকে এডিটেড বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমরা বন্ধুবান্ধবেরা টানেল দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা খুবই স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়েছি। আমরা কোনো রেস করিনি। ‘দ্য স্লো কিডস’ ঢাকার একটি গ্রুপ বলে মন্তব্য করে আশরাফুল হক বলেন, ওদের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। তবে তাদের ভিডিওটি এডিট করে ভাইরাল করে দেয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
কর্ণফুলী টানেলের পিডি ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশীদ বলেছেন, বিষয়টিকে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। গাড়ি নিয়ে তারা যা করেছে তা বেআইনী। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। যুবকদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। টানেলের ভিতরে ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো বেআইনী বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, টানেলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো পুরো বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছে। তারা যুবকদের চিহ্নিত করার কাজ করছে। এদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।