জুম’আর খুতবা

ওলীকুল শিরোমণি হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি একটি আদর্শ জীবন

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

হাদীস শরীফের আলোকে ওলীর পরিচয়: হাদীস শরীফে আল্লাহর ওলীদের পরিচয় মর্যাদা ও গুরুত্ব উল্লেখ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “ওলী আল্লাহ হচ্ছেন তাঁরা যাদের দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে যায়। যাদের সান্নিধ্যে বসলে নৈতিকথা পরিশুদ্ধ হয়, বান্দা আদর্শ জীবন গঠনে ধন্য হয়। যাদের সান্নিধ্য আদর্শ ও শিক্ষা অর্জন করলে বান্দা অন্যায়, অসত্য, পাপাচার, ব্যাভীচার মিথ্যাচার শরীয়ত বিরোধী ও মানবতা বিরোধী অপকর্ম থেকে বিরত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে, তাঁদের পরিচয় প্রসঙ্গে নুরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “ওলীগণ এমন সম্প্রদায় যাঁদের সান্নিধ্য অর্জনকারী ও সঙ্গলাভকারী ব্যক্তি পাপী থাকেনা।” [মুসলিম শরীফ, খন্ড: , পৃ:১৯৯, আল কাউলুল জাসীল, পৃ: ৬০ কৃত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (.)]

শায়খের জন্ম: হযরত গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ৪৭০ মতান্তরে ৪৭১ হিজরি মোতাবেক ১ রমজান (২৯ শাবান দিবাগত রজনী) ১৮ মার্চ ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে শত সহস্র আউলিয়াদের স্মৃতি বিজড়িত ইরাকের জিলান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। (তাযকিরায়ে মাশায়েখে কাদেরীয়া, পৃ: ২২৭)

বুজুর্গ পিতামাতা: তাঁর সম্মানিত বুজুর্গ পিতা সায়্যিদ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত, মাতার নাম উম্মুল খায়ের ফাতেমা। পিতার দিক থেকে তাঁর বংশীয় শাজরা সায়্যিদিনা ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সম্পৃক্ত। মাতার দিক থেকে তাঁর বংশধারা হযরত সায়্যিদিনা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সম্পৃক্ত। পিতৃকুল মাতৃকুল উভয় দিক দিয়ে তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বংশধর ছিলেন। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গাউসে পাকের বংশীয় মার্যাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, তু হোসাইনী হাসানী কেউ বা মহিউদ্দীন হো, আয় খাদ্বিয়ে মাজমা’ই বাহারাঈন হে চশমা তেরা। ওহে গউসুল আ’যম আপনি তো হাসানী ও হোসাইনী আপনি মহি উদ্দীন বা দ্বীনের পুনরুজ্জীবিতকারী কেন হবেন না? যেহেতু বেলায়তের দুই সমুদ্রের মিলন মোহনায় আপনার উৎসধারা। আপনার কারণে ইসলামের বাগান আজ সবুজ সতেজ ও আলোকিত।

জন্মের পর কারামাত প্রকাশ ও রোযা পালন: হুযুর গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (.) ছিলেন, মাতৃগর্ভের ওলী। জন্মের পরেই তাঁর কারামাত প্রকাশ পেল, রমজানের ১ তরিখ তার জন্ম হয়। পূর্ণ রমজান মাসে তিনি সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি কখনো দুধ পান করেন নি, ইফতারের সময় যখন মাগরিবের আজান হতো তখনি তিনি দুধ পান করতেন। এ ঘটনা জিলান শহরের সর্বত্র এভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করলো যে সম্ভ্রান্ত অভিজাত পরিবারে এমন একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে, যিনি রমজান শরীফে দিনের বেলায় দুধ পান করে না। (কালায়েদুল জাওয়াহের, পৃ:০৩)

শৈশবকালে গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেতেন:

শৈশব কালে তিনি অন্য ছেলে সন্তানের মতো খেলাধুলায় মত্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক ব্যাতিক্রম আদর্শ স্বভাব প্রকৃতির। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বর্ণনা করেন, যখনই আমার অন্তরে সহপাঠিদের সাথে খেলাধুলার ইচ্ছে জাগ্রত হত তখনি আমি অদৃশ্য থেকে এক প্রকার গায়বী আওয়াজ শুনতে পেতাম কেউ আমাকে আহবান করতেন, হে মুবারক! তুমি আমার দিকে মনোনিবেশ করো। (বাহজাতুল আসরার, পৃ: ৫০)

শৈশবে মক্তবে গমনকালীন কারামাত: ওলীকুল শিরোমণি হযরত আবদুল কাদের জিলানী (.) নিজেই বর্ণনা করেছেন, দশ বৎসর বয়সে আমি যখন মক্তবে যাতায়াত করতাম যাত্রাপথে আমার পেছনে পেছনে ফেরেস্তাগনকে আমার সাথে চলতে দেখতে পেতাম। আমি মক্তবে পৌছার পর ফেরেস্তাগণ আমার সহপাঠিদের বলতে শুনতাম। “তোমরা আল্লাহর ওলীর জন্য বসার জায়গা করে দাও মক্তবে উপস্থিত সকলে এ আওয়াজ শুনতে পেতেন। (বাহজাতুল আসরার, পৃ: ৪৭, কালায়েদুল জাওয়াহির, পৃ: , যুবদাতুল আছার, পৃ: ৭৯)

ইলমে দ্বীন অর্জনের জন্য বাগদাদ সফর ও মায়ের আদেশ পালন: আমাদের বড়পীর হুযুর গাউসে আযম আবদুল কাদের জিলানী (.) আঠার বৎসর বয়সে মহিয়সী মাতার অনুমতিক্রমে বাগদাদগামী এক কাফেলার সাথে ইলমে দ্বীন অর্জনের প্রত্যয়ে প্রায় চারশত মাইলের দূরত্বে সফরে বের হলেন, কফেলা যখন হামদান অতিক্রম করলো পথিমধ্যে ডাকাত দল গতিরোধ করল, আক্রমন করল মালামাল সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিল। গাউসে পাক এক প্রান্তে দাড়িয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে, একজন ডাকাত নিকটে এসে জিজ্ঞেস করলো প্রিয় বৎস! বলো তোমার কাছে কিছু আছে কী? তিনি উত্তর দিলেন জী হ্যাঁ আমার নিকট চল্লিশটি দিনার আছে, ডাকাত তাঁর কথাকে ঠাট্টা মনে করে চলে গেল, কিছুক্ষণ পর অন্য আর একজন ডাকাত এসে অনুরূপ প্রশ্ন করলো শায়খ তাঁকেও পূর্বের ডাকাতের মতো অনুরূপ উত্তর দিলে তিনিও এটাকে ঠাট্টা মনে করে চলে গেল উভয় ডাকাত দলপতির নিকট গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করলো, ডাকাত দলপতি উভয়ের কথা শুনে বললো, ছেলেটিকে আমার কাছে নিয়ে এসা! হুযুর গাউসে পাককে ডাকাত সর্দারের নিকট নিয়ে যাওয়া হল ডাকাত সর্দার জিজ্ঞেস করলো ওহে ছেলে? সত্য করে বলো! তোমার কাছে কি আছে? তিনি উত্তর দেন আমার কাছে চল্লিশটি দিনার আছে, জিজ্ঞেস করা হলো কোথায় রেখেছো! উত্তর দিলেন আমার আস্তিনের পকেটে সেলাই করা অবস্থায় আছে, ডাকাত সর্দারের নির্দেশ মতে চল্লিশ দিনার বের করে দিলেন, ডাকাত দল ও সর্দার এ বালকের সততা দেখে বিস্ময়ে হতবাক! ডাকাত সর্দার বললো, বালক! তুমি তো নিশ্চয় জেনেছো আমরা হলাম ডাকাত দল আমরা মুসাফিরদের সর্বস্ব লণ্ঠন ও ডাকাতি করি। তোমার কাছে তো দিনার গুলো গোপনভাবে সংরক্ষিত ছিল তুমি কেন এগুলোর কথা প্রকাশ করে দিলে? শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (.) মুসকী হেসে বলে দিলেন, আমি কেন মিথ্যা বলবো! তোমরা জিজ্ঞেস করেছো আমি সত্যটি প্রকাশ করলাম, আমার বিদায় কালীন আমার আম্মাজানের সাথে এ অঙ্গীকার করেছিলাম পরিস্থিতি যতই কঠিন হউক যতই নাজুক হউক কোন অবস্থাতেই যেন মিথ্যা না বলি সদা সর্বদা যেন সত্য কথা বলি, আমি আপনাদের ভয়ে কেন আম্মাজানের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করব? আমার মমতাময়ী মাতার উপদেশ অমান্য করে কেন তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হব। হুযুর গাউসে পাকের হৃদয়গ্রাহী কথাগুলো ডাকাত সর্দারের অন্তরে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করলো ডাকাত দলের সর্দার খুবই ক্রন্দন করল নিজের কৃতকর্মের উপর অনুতপ্ত হলো, বললো ওহে ছেলে! তুমি তো তোমার মায়ের সাথে কৃত অঙ্গীকার যথাযথ ভাবে পালন করে যাচ্ছো। হায় আফসোস আমার জীবনের উপর আমি তো প্রতিনিয়ত আমার আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে চলছি। একথা বলে ডাকাত সর্দার হুযুর গাউসে পাকের কদমে লুটিয়ে পড়লো তাওবা করলো ডাকাত দলের সদস্যরা এ অবস্থা দেখে হঠাৎ তাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন এসে গেল, সর্দারের অনুকরণে তারা সকলে বিশুদ্ধ নিয়তে তাওবা করে নিলো। কাফেলার লুণ্ঠিত মালামাল ফেরত দিয়ে দিল, নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলো অপরাধ জগত থেকে ফিরে এলো ইবাদত রিয়াজত নিজ যুগের নেককার সালেহীন পূণ্যাত্ন বান্দা হিসেবে নিজেদেরকে অন্তর্ভূক্ত করে নিলেন। হুযুর গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানী বলেন, সর্ব প্রথম আমার হাতে তারাই তাওবা করেছিলেন। (বাহজাতুল আসরার, পৃ: ২৫৬, কালায়েদুল জাওয়াহের, পৃ: ০৯)

শিক্ষার্জন: হুযুর গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানী (.) “ মদীনাতুল ইলম” বাগদাদ পৌছে সেখানকার প্রসিদ্ধ বিদ্যাপীঠ “জামেয়া নিজামীয়ায় ভর্তি হন, যুগ শ্রেষ্ঠ খ্যাতিমান হাদীস বিশারদ ও তাফসীরকারদের সান্নিধ্যে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রজ্ঞা ও বুৎপত্তি অর্জন করেন। আল্লামা আবু জাকারিয়া ইয়াহিয়া ইবনে আলীর সান্নিধ্যে থেকে আরবি সাহিত্য, আবুল ওয়াফা আলী ইবনে আকীল, মুহাম্মদ বিন কাযী আবু ইয়ালা এবং হযরত কাযী আবু সাঈদ মাখযুমী প্রমূখের সান্নিধ্যে ইসলামী ফিকহ ও উসূল শাস্ত্রে পূর্ণতা অর্জন করেন এ ছাড়াও হযরত আবু গালিব মুহাম্মদ বিন হাসান বাকিল্লানী প্রমূখ ঘতের জন প্রথিতযশা হাদীস বিশারদের সান্নিধ্যে থেকে হাদীস শাস্ত্রে গভীর পান্ডিত্য ও বুৎপত্তি অর্জন করেন। (আনোয়ারুল বয়ান, ১ম খন্ড, পৃ: ৫৪৯)

ইলমে দ্বীনের খিদমত ও তিরোধান: হযরত গাউসুল আযম দস্তগীর (.) ৯১ বছর বয়সের মধ্যে একাধারে ৫০ বৎসর ইলমে জাহের ও ইলমে বাতেন উভয়দিকে পূর্ণতা অর্জনে ব্রতী ছিলেন। অবশিষ্ট ৪১ বৎসরে মধ্যে একাধারে ৩৩ বৎসর ইলমে দ্বীনের প্রচার প্রসার, সংরক্ষণ, পরিচালনা ও গুরুদায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিলেন ৫৬১ হিজরি সন ১১ রবিউস সানী সোমবার ৯১ বৎসর বয়সে তাঁর মওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে গমন করেন। “ওলীকুলের শিরোমনি মানবকুলের সুলতান, এশক নিয়ে এসেছেন পূর্ণতায় তিরোধান।” আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ মহান ওলীর আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউম্মতের প্রতি নবীজীর ও নবীজীর প্রতি মুমিনদের ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধকে বাজায় বাঁশি হে