গাজায় মুসলমানদের ওপর ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিষয়টি এতটাই মর্মান্তিক যে তার বাইরে কোনও বিষয় লিখতে বা আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না। মুসলমান শিশু এবং নারীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। গির্জা কিংবা মসজিদ, আহত হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া অসুস্থ লোকদের হত্যা করা হচ্ছে। গাজায় বসবাসরত মানুষদের কোনও খাবার, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি কিছুই নেই। এমন বর্বর অবস্থায় মানুষ বসবাস করতে পারে বলে মনে হয় না। বিশ্ব গণমাধ্যম সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম ইজরায়েলি বর্বরতাকে সমর্থন জানাচ্ছে, তাদের পক্ষে সংবাদ প্রচার করছে এবং ঘটনার বিশ্লেষণ জানাচ্ছে। মুসলমান দেশগুলি ফিলিস্তিনের ইসরায়েলি হামলার শিকার মানুষের পক্ষে সংবাদ প্রচার করছে। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে উচিত ছিল সত্য বলা। বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনী যখন ইহুদিদের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তখন তারা প্রথমে নারী ও শিশুদের হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের বংশের বিনাশ ঘটানো। এখন ইহুদিরা ফিলিস্তিনে হিটলারের মতো নারী এবং শিশুদের হত্যা করছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনি মুসলমানদের বংশ নিঃশেষ করে দেয়া। ফিলিস্তিনিরা তাদের বাচ্চাদের হাতে এবং পায়ে আরবি ভাষায় নাম লিখে রাখছে যাতে মৃত্যুর পর লাশ শনাক্ত করতে পারে। পশ্চিমা গণমাধ্যম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছে ৭ অক্টোবর হামাস যে হামলা করেছে তা ছিল আগ্রাসী হামলা। হামাসের এই আগ্রাসী হামলা রুখে দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ইসরায়েলকে অর্থ এবং অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে। কিন্তু ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গাজা পশ্চিম তীর এলাকায় ফিলিস্তিনিদের আবাস ভূমির ওপর যে আগ্রাসন চালানো হচ্ছে সেটি তারা বলছেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের উপর ইসরাইলিদের অধিকার রয়েছে।
গাজা তুরস্কের শাসক অটোম্যান সম্রাটদের অধীনে ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর তা ব্রিটেনের অধীনে চলে যায়। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তারাও জেরুজালেম দখল করে নেয়। জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ মুসলমানদের কাছে অতি পবিত্র উপাসনালয়। এই জেরুজালেম খ্রিস্টানদের কাছেও পবিত্র। কারণ খ্রিস্টানরা মনে করেন যিশু খ্রিস্টকে এই স্থানে ত্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। ইহুদিরা মনে করে এই জেরুজালেম হচ্ছে তাদের “গোল্ডেন টেম্পল”। অনেক আগে থেকেই জেরুজালেমের ওপর ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের আগ্রহ ছিল। ইসরাইল ১৯৬৭ সালের পর থেকে মুসলমানদের আল আকসা মসজিদে নামাজ আদায়ে বাধার সৃষ্টি করে। এমনকি এই মসজিদে ইহুদিদের ঢোকার অনুমতি দেয় এবং প্রায় সময় ইহুদিরা নামাজরত মুসল্লিদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাত। ধীরে ধীরে পশ্চিম তীর এবং গাজায় অবৈধ বসতি স্থাপন শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার জন্য এবং একটি আলাদা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইয়াসির আরাফাত এবং তাঁর সংগঠন পিএলও সংগ্রাম করে আসছিল। তাদেরকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েল হামাস প্রতিষ্ঠা করে। এই হামাস পরবর্তী কালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল এর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশরা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ দখল করে ২০০ থেকে ৩০০ বছর ধরে লুণ্ঠন কার্য চালিয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নাই যা ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল না। তখন বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায় না। বার্মা, বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত এবং শোষিত হয়েছে। সেই ব্রিটেন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর জাতিসংঘের প্রস্তাবের মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে মুসলমানদের জন্য বিরাট এক সমস্যার সৃষ্টি করে।
আমাদের গণমাধ্যমে একজন সাংবাদিক সমপ্রতি বলেছেন গাজায় হওয়া হামলা রোখার জন্য কেন মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে বলা হচ্ছে? এর জন্য তো বিশ্বমানবতাকে ডাক দেওয়া উচিত। আমার মনে হয় বিশ্বমানবতা এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলির শাসকরা মুসলমানদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করছে। সুতরাং গাজা এবং পশ্চিম তীরকে রক্ষা করার জন্য মুসলমানদেরকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। হাসপাতালে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা দেখে একজন ফিলিস্তিনি আর্টিস্ট একটি কার্টুন এঁকেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন এক ফিলিস্তিনি মা তাঁর শিশুকে দুইবার বহন করছে। এই কার্টুনের নিচে আরবিতে ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে। একবার বহন করছে তার জন্ম দেওয়ার সময়, দ্বিতীয়বার বহন করছে ইজরায়েলের বোমার আঘাতে মৃত্যুবরণ করার পর কবর দেওয়ার সময়। এই নির্মমতার কোনও জবাব নেই। ফিলিস্তিনে যা ঘটছে সেটা শুধু মানবাধিকারের বিপর্যয় নয়। সেটা মানবতার বিপর্যয়। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের মতো দেশের কখনও বোধোদয় হবে না। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইসরাইলকে এই যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে অস্ত্রবিরতি করতে বাধ্য করার একটি উপায় আছে। সেটি হল, ইসরায়েল বিমান হামলার জন্য যে সব বিমান ব্যবহার করছে তাতে জেট ফুয়েল বা জ্বালানি তেলের দরকার। যে ট্যাঙ্ক দিয়ে স্থল আক্রমণ করার চেষ্টা করছে, সেই ট্যাঙ্কেও জ্বালানি তেলের দরকার। যুদ্ধ পরিচালনার প্রতিটি বাহনে তেল দরকার। ইসরায়েল মুসলিম দেশগুলির কাছ থেকে তাদের যুদ্ধপরিচালনার যে তেলের দরকার তার ৬০ ভাগ থেকে ৯০ ভাগ কিনে। ইসরায়েলের তেলের ১০ ভাগের মত পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আসে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে F16 বিমান দিতে পারবে কিন্তু জ্বালানি দিতে পারবেনা। অতীতেও দেখা গিয়েছে আরব বিশ্ব যখন জ্বালানি তেলের সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তখন ইসরায়েল বাধ্য হয়েছিল ফিলিস্তিনের সাথে যুদ্ধ বিরতি করেছে। এবারও মুসলিম দেশগুলি যদি ইসরাইলকে তেল সরবরাহ না করে বা আমেরিকা, ব্রিটেনে তেল সরবরাহে ধীরগতি অবলম্বন করে তাহলেই যুদ্ধ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে।
আমার মনে হয় যে মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনের গণহত্যা বন্ধের কোনও সুযোগ থাকলে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষ ইসরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আয়ারল্যান্ড সরকার পুরোপুরি ইসরায়েলি হামলার বিরোধিতা করছে। কিন্তু ভারতে যখন মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে, ভারত সরকার বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করেছে। আমাদের দেশে সরকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিয়ে মসজিদে দোয়া করেছে এবং পতাকা অর্ধনমিত রেখেছে। এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। সরকার যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটি তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে যে কোনও দেশ তার নিজের বেলায় নিতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয়ে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল, বাংলাদেশের জনগণ তার দেশের সরকার কীভাবে পরিচালিত হবে সেটি ঠিক করবে। সেজন্য একটি সঠিক এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার। নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে সরকার যদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, পশ্চিমা দেশের বাধা কোনও কাজে আসবে না। এ ব্যাপারে যদি সরকারের কোনো ব্যর্থতা থাকে তাহলে আন্দোলনকারী দলগুলি কর্মসূচি নিবে। সারা বিশ্বের যে পরিস্থিতি এতে আমাদের রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা একান্ত প্রয়োজন এবং সে জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলেরও চেষ্টা থাকা দরকার।
আমরা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্কিত। অনেকে মনে করেন যে আমাদের পোশাক শিল্পের রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা যদি আমাদের রপ্তানি ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ পোশাক কিনে। এটি অনেক কম দামে তারা কিনে। সুতরাং তারাও চাইবে না যে আমাদের পোশাক কেনার ক্ষেত্রে তারা সহজেই নিষেধাজ্ঞা দেবে। তা ছাড়া আমাদের দেশের তেল উত্তোলন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের বিনিয়োগ আছে এবং আমাদের দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে তাদের কোম্পানিগুলি অনেক সুবিধা অর্জন করে। সুতরাং বাংলাদেশ খুব একটা নরম অর্থনীতির দেশ, এটা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অবস্থা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে আমাদের অর্থনীতির উপরে আঘাত আসার সম্ভাবনা খুব বেশি নেই। আমাদের রাজনীতি ভালো থাকলে, অর্থনীতিও ভালো থাকবে। আমরা ফিলিস্তিনের বিষয়ে আলোচনা করেছি। এরকম অনেক দেশ পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বারা যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, আমাদের বাংলাদেশ যাতে সেরকম না হয় সেই ব্যাপারে সরকার এবং বিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলি চেষ্টা চালিয়ে যাবে এটাই আশা করি।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম; শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক।