বিশ্ববাসীসহ দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে সংযুক্তির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম শহর–বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত–সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। ফলে ভ্রমণ সময় ও খরচ কমবে এবং পূর্ব প্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত মালামাল পরিবহন প্রক্রিয়া সহজতর হবে। কর্ণফুলী টানেল শুধু দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে না, দেশের প্রধান পর্যটন এলাকাগুলোর মধ্যে কক্সবাজার–সেন্টমার্টিন–বান্দরবানসহ পাহাড়, সমুদ্র ও নদীর ত্রিমাত্রিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশি–বিদেশি পর্যটকদের সহজতর যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকা রাখবে।
কর্ণফুলি নদীর ওপর যখন পিলার সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন সে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তৎকালীন মেয়র প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি দাবি তুলেছিলেন কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের। উন্নত বিশ্বের টানেলের বাস্তবতা যা আমাদের কাছে কেবলই স্বপ্নের, যেন শুধুই ছবি মাত্র। মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে সেদিনের সে অলীক স্বপ্ন যা আজ নিখাদ বাস্তবতা। স্বপ্নময় এই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধনের পথে।
প্রথমত, বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের অবকাঠামো আধুনিকায়ন এবং সংযোগ উন্নত করার প্রতিশ্রুতির প্রতীক। টানেল নির্মাণ দেশের পরিবহন সেক্টরের উন্নয়নে সরকারের সংকল্পের প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দেশের পর্যটনকেও উৎসাহিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। টানেলের ফলে পর্যটকদের জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ভ্রমণ করা সহজ হবে, এটি শুধুমাত্র পর্যটন শিল্পকে উপকৃত করবে না বরং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর, এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বন্দরের কর্মক্ষমতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যাই হোক, বন্দরের প্রায়শই যানজটে থাকে এবং পণ্য আসতে এবং বাইরে যেতে দীর্ঘ বিলম্ব হয়। টানেলটি চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহনে একটি বিকল্প পথ হয়ে উঠবে ফলে বন্দরে যানজট হ্রাস করবে এবং ব্যবসায়িকদের জন্য পণ্য আনা–নেওয়া সহজতর করবে। বীর চট্টলাবাসী এ টানেলটির একটি মাধ্যমে দ্রুত, নিরাপদে এবং আরও নির্ভরযোগ্য উপায়ে স্বল্প খরচে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এ টানেল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করবে এবং প্রবৃদ্ধিকে বাড়াবে।
তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধু টানেল আঞ্চলিক সংহতি ও সংযোগকে উৎসাহিত করবে। বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত এবং টানেলটি দেশটিকে পূর্ব–পশ্চিম করিডোরের সাথে সংযুক্ত করবে, যা মিয়ানমার থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি আঞ্চলিক ব্যবসা–বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত করবে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মধ্যে পণ্য ও জনগণের চলাচল সহজতর করবে।
চতুর্থত, বঙ্গবন্ধু টানেল নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। টানেলটির নির্মাণ ইতিমধ্যেই হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং টানেলের কার্যক্রম পরিবহন, লজিস্টিক, পর্যটন এবং অন্যান্য খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। টানেলটি চট্টগ্রাম এবং আশেপাশের এলাকায় নতুন বিনিয়োগকেও আকৃষ্ট করবে।
পঞ্চমত, বঙ্গবন্ধু টানেল নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা উন্নত করবে ফলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঝুঁকি হ্রাস করবে। টানেলটি চোরাচালান এবং অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপের ঝুঁকি হ্রাস করে নিরাপত্তার উন্নতি করবে।
এছাড়া টানেলটির নির্মাণ পরিবেশের ওপর পরিবহণ খাতের নেতিবাচক প্রভাব কমাবে এবং টানেল নিজেই ফেরি এবং পরিবহনের অন্যান্য পদ্ধতির ওপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে দেবে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্রান্তিক কৃষক এবং ছোট ব্যবসার জন্য তাদের পণ্য বিক্রি করা এবং তাদের আয় বৃদ্ধি করা সহজ করে তুলবে। এটি গ্রামীণ উন্নয়নকে উৎসাহিত করবে এবং শহরাঞ্চলের ওপর চাপ কমিয়ে দেবে, যা বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি।