প্রখ্যাত গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণা ইতিহাস চর্চায় একটি নতুন ধারা সংযোজন করেছে। কিন্তু তিনি শুধু চট্টগ্রাম নয়, আরাকান এবং সিলেটকেও তাঁর গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করে ইতিহাস চর্চায় বহুদূর এগিয়ে গেছেন। চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তাঁকে চট্টলতত্ত্ববিদ আখ্যা দেয়া হয়।
‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি’, নামে যে বৃহৎ গ্রন্থ তিনি লিখেছেন,-তা’ ইতিহাসের গণ্ডি অতিক্রম করে সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, মানববিদ্যা ইত্যাদি আরো নানা শাস্ত্রের আঙিনায় ঢুকে পড়েছে। গ্রন্থের নামেই স্পষ্ট শুধু মানুষের সমাজ নয়, তার সাংস্কৃতিক পরিচয় উদঘাটনের চেষ্টাও তিনি করেছেন।
আবদুল হক চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যাঁরা জ্ঞানমার্গে বিচরণ করেন, তাঁরা সাধারণত স্বদেশ, স্বজাতি এবং সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। আবদুল হক চৌধুরী সেদিকেও চোখ–কান খোলা রাখতেন, তিনি একজন দেশপ্রেমিক, সমাজসচেতন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সমকালে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন–শোষণ থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তা’ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ণাহুতি প্রাপ্ত হয়, আবদুল হক চৌধুরী সেদিকে গভীর মনোযোগ সহকারে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। মনে মনে তিনি নিজেকেও স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামরত ছাত্র–জনতার প্রতি তাঁর গভীর সভানুভূতি ছিলো, তিনি নিজেও মানসিকভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তিনিও তো বাঙালি জাতির অংশ; অন্যদিকে তাঁর ছেলে মুহাম্মদ আমিন চৌধুরী (পরবর্তীকালে অ্যাডভোকেট), শহীদুল আমিন চৌধুরী, মনজুর উল আমিন চৌধুরী, মনসুর উল আমিন চৌধুরী, তাঁরাও যে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলো, তা’ তিনি জানতেন। সেজন্যই তো দেখি মুক্তিযুদ্ধে ফকা চৌধুরীর খুনি রাজাকাররা তাঁর ছেলে অ্যাডভোকেট আমিন এবং শহীদুল আমিনসহ তাঁকে ধরে থানায় সোপর্দ করেছিলো। তাঁর চোখের সামনে রাজাকাররা তাঁর ছেলেদের নির্যাতন করতে দেখে তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না অক্ষম পিতার।
আবদুল হক চৌধুরীকে ইতিহাস চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মনীষী আবদুল করিম চৌধুরী বিশারদ। যিনি প্রাচীন পুঁথি, পাণ্ডুলিপি, পুস্তক, দলিল সংগ্রহ ও সম্পাদনা ছাড়াও ‘ইসলামাবাদ’ নামে একটি ইতিহাস গ্রন্থ এবং ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সহযোগে ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। চট্টগ্রামের ইতিহাসে চর্চায় দুটি বই–ই মূল্যবান সংযোজন।
সাহিত্য বিশারদকে দেখে এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলে আবদুল চৌধুরী অনুপ্রাণিত বোধ করেন। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের সমস্ত দায়দায়িত্ব এসে পড়ে তরুণ আবদুল হক চৌধুরীর ওপর। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে মামলা–মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। স্কুলের হেড মাস্টার অনুগ্রহ করে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। তবে মামলা–মোকদ্দমা করতে গিয়ে প্রাচীন দলিলপত্র নিয়ে তাঁকে পড়াশোনা করতে হয়। প্রাচীন ইতিহাসের নানাসূত্র তাঁর কাছে উন্মোচিত হতে থাকে, তিনি ইতিহাসের নিবিষ্ট পাঠক হয়ে পড়েন।
আবদুল হক চৌধুরী উত্তর চট্টগ্রামের যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন, তার আশেপাশে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন চোখে পড়ে। বাড়ির পূর্ব–উত্তর দিকে ঈসা খাঁর দীঘি, গ্রামের পশ্চিম পাশে নশরত শাহের দীঘি; অন্যান্য গ্রামেও এরকম অগুনতি নিদর্শন আছে। আবদুল হক চৌধুরী পুরানো নথিপত্র ঘেঁটে এসব কীর্তির ঐতিহাসিক সূত্র জেনে নেন। মামলায় জড়ালেও তাঁর ব্যক্তিগত পড়াশোনা ও অনুসন্ধান কমে যায় নি। পিতা শরফুদ্দিন সাহেব বাড়ির পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে আবদুল হক চৌধুরী প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের কাজে ব্রতী হন। বেতন ছিল মাসিক ১৫ টাকা ।
তিনি এবং তাঁর আরেক বন্ধু কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মোহাম্মদী’ ও ‘বুলবুল ‘ পত্রিকার গ্রাহক হয়েছিলেন। এসব পত্রপত্রিকার সূত্রে দেশের সারস্বত সমাজের কাজকর্মের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ঐকান্তিক আগ্রহে তখন অনেকেই প্রাচীন পুঁথিপত্র সংগ্রহের কাজ করতেন। চট্টগ্রামে পাড়ায়–পাড়ায় পুথি পাঠের রেওয়াজ ছিল। হিন্দু মুসলমান উভয় সমপ্রদায়েই এ ব্যবস্থা ছিল। একজন পুথি পাঠ করতেন আর একজন পঠিত অংশের ব্যাখ্যা করতেন। শ্রোতারা গভীর রাত পর্যন্ত এসব উপভোগ করতেন। অনেক বাড়িতে পুঁথি সংগৃহীত থাকতো। হাতেলেখা পুঁথিও ছিল, ছাপার পুঁথিও ছিল। বিয়ে–শাদী উপলক্ষে পুথি পাঠ অনুষ্ঠিত হতো। যে–বাড়িতে পুথি পাঠ হতো সে বাড়ির পক্ষ থেকে অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করা হতো।
আবদুল হক চৌধুরীদের পরিবারেও পুঁথির ঐতিহ্য ছিল। পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে কোরেশী মাগনের কাহিনী তিনি জেনেছিলেন। কোরেশী মাগন আর মাগন ঠাকুর যে একই ব্যক্তি এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি একটি বংশলতিকা তৈরি করে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। এইভাবে তিনি ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রয়াসের মধ্যে প্রবেশ করেন। বৈবাহিক সূত্রে ড. মুহম্মদ এনামুল হকের পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। ড. হকের শ্যালকের মেয়ের সঙ্গে আবদুল হক চৌধুরী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বলতে গেলে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও মুহম্মদ এনামুল হক প্রণীত ‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গলা সাহিত্য’ তাঁকে চট্টগ্রাম–আরাকান–ত্রিপুরার মধ্যযুগের ইতিহাসের নিবিষ্ট পাঠকে পরিণত করে। তিনি গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে প্রাচীন দীঘি, মসজিদ, মন্দির, দুর্গ ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ ও ভগ্নাবশেষ নিয়ে ভাবতে থাকেন। পদ্ধতিগতভাবে তালিকা তৈরি করা। নোট নেওয়া, নোট রাখা এসব তিনি কিছুই করতেন না কিন্তু নতুন উপাত্ত পেলেই সেটা মাথায় রাখতেন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপাত্তের সঙ্গে মিলিয়ে কাহিনী পূর্ণাঙ্গ করতে চাইতেন। এভাবে তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন চট্টগ্রামের ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের এক চলমান এনসাইক্লোপেডিয়া। তাঁকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাচীন পুথির বিবরণ উপহার দিয়েছিলেন। এইভাবে আঞ্চলিক ঐতিহ্য পুনর্মূল্যায়নের অঙ্গীকার তাঁর মধ্যে দৃঢ় হয়।
ইতিহাস চর্চায় আবদুল হক চৌধুরীর মূল্যবান গবেষণা ও অবদানের জন্য তাঁকে ২০১১ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
আবদুল হক চৌধুরীর স্মৃতি সংরক্ষণ ও তাঁর জন্মস্থানকে ঘিরে ইতিহাস চর্চা ও গবেষণাকর্মের একটি পরিমণ্ডল সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের তিনটি জেলায় তিনজন বরেণ্য ব্যক্তির স্মৃতিকেন্দ্র/ সংগ্রহশালা স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পভুক্ত চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াজিশপুর গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, চট্টলতত্ত্ববিদ, গবেষক আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতিকেন্দ্র/ সংগ্রহশালা স্থাপন করা হয়েছে।
গত বছরের ২৬ অক্টোবর আবদুল হক চৌধুরীর ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারের পক্ষে এই স্মৃতিকেন্দ্র/ সংগ্রহশালার জন্য ২৬ শতক জমি দানপত্র মূলে হস্তান্তর করেন আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতি পরিষদের নির্বাহী সদস্য মরহুমের পুত্র ঘাসফুল চেয়ারম্যান ও চবি সিনেট সদস্য, সমাজবিজ্ঞানী ড. মনজুর উল আমিন চৌধুরী। গত ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সচিব ও বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব গাজী মো. ওয়ালি উল হক স্বাক্ষরিত পত্র স্মারক নং ৪৩.২২.০০০০.০০৩.০১.৭৮২.২২.১৫২৩ এর মাধ্যমে আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতিকেন্দ্র/ সংগ্রহশালাটি জাতীয় জাদুঘরের শাখা জাদুঘর হিসেবে পরিচালনা ও জমি হস্তান্তরের বিষয়টি ড. মনজুর উল আমিন চৌধুরীকে নিশ্চিত করেন। আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতিকেন্দ্র/সংগ্রহশালা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৮ম শাখা জাদুঘর। উল্লেখ্য, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে উক্ত জমিতে দ্বিতল ভবন নির্মিত হয়েছে।
আবদুল হক চৌধুরীর জন্মতীর্থে তাঁর নামে স্মৃতিকেন্দ্র/সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যিনি তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনা এবং গবেষণার সন্ধানী আলো ফেলে চট্টগ্রামের অজানা প্রদেশকে আলোকিত করেছেন এবং চট্টগ্রামকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন, তাঁর নামেই তো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের স্মৃতিকেন্দ্র হওয়া উচিত। একদিন এই স্মৃতিকেন্দ্র চট্টলবাসী তথা সমগ্র দেশবাসীর তীর্থস্থানে পরিণত হবে।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক