একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। যেমন রোধ হচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা, তেমনি রেলপথেও থেমে নেই দুর্ঘটনা। থামানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনায় মৃত্যু। অসাবধানতা থেকে শুরু করে নানা কারণেই যখন দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা কতটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে স্পষ্ট করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সোমবার কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রীবাহী ট্রেনে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় অন্তত ১৭ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। বেলা সোয়া তিনটার দিকে ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাদিকুর রহমান পত্রিকাকে জানিয়েছেন, আহত অনেকে ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে থাকতে পারেন। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালবাহী ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, আর যাত্রীবাহী এগারোসিন্ধুর ট্রেনটি যাচ্ছিল ভৈরব থেকে ঢাকার দিকে। ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষ দুই বগিতে ধাক্কা দেয় মালবাহী ট্রেনটি। এ সময় যাত্রীবাহী ট্রেনের দুটি বগি উল্টে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারকাজে এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন। ভয়াবহ এই ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে আর এই দুর্ঘটনার তদন্তে গঠন করা হয়েছে দু’টি কমিটি।
ট্রেন দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে– রেলপথ, রোলিং স্টক, সিগনালিং লেভেল ক্রসিং সংশ্লিষ্ট ত্রুটি, জনবল সংকটের কারণে ট্র্যাক, কোচ, ব্রিজ ইত্যাদি মেইনটেইন্যান্সের অভাব, অবৈধ লেভেল ক্রসিং গেট দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত সড়কযান পারাপার, সচেতনতার অভাব, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ইঞ্জিন বিকলতা, ট্রেন থেকে যাত্রী পড়ে যাওয়া বা লাফ দেওয়া, রেল লাইন ভেঙে যাওয়া, টেলিফোন ব্যবস্থার বিশেষ ক্ষতি হওয়া, পয়েন্ট ফেটে যাওয়া, ট্রেন পাটিং, লাইন চ্যুতি, রেলগাড়ি সংক্রান্ত হিংসাত্মক কার্যকলাপ, সড়কযানসহ লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো বাধার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়া, গরু–বাছুর জাতীয় প্রাণীর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়া, বেশি বন্যার কারণে ট্রেন চলাচল বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ইত্যাদি।
দু বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে ৬ পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছিলেন রেলপথমন্ত্রী। তাঁর দেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে– রেল সংক্রান্ত দুর্ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে সমন্বিত ও কার্যক্রম পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ট্রেন ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটালাইজেশন করার প্রক্রিয়া চলমান রাখা; রেলট্র্যাক, রোলিংস্টক, ট্রেন অপারেশন, সিগনালিং সিস্টেম প্রভৃতি উন্নয়নে দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া, এ লক্ষ্যে ডিপিপি প্রণয়নের কাজ অব্যাহত রাখা। এছাড়া ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের আরও সচেতনভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন মোটিভেশনাল কার্যক্রম গ্রহণ করা; রেলপথের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং ওয়ার্কশপ আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আট বছরে শুধু ট্রেন দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৯৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন রেলক্রসিংয়ে। একই সময়ে ট্রেনের ধাক্কা, লেভেলক্রসিং, আত্মহত্যাসহ বিভিন্নভাবে মারা গেছেন ৫ হাজার ৬০০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রেল ভ্রমণে আর কোনো মানুষের প্রাণ যাক, তা আমরা চাই না। রেল ভ্রমণে মৃত্যু খুবই মানসিকভাবে আমাদের কষ্ট দিয়ে থাকে। তাই এ বিষয়ে জনবল বাড়িয়ে দুর্ঘটনা কমাতে হবে। একেকটি মৃত্যু একেকটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর তথ্য মতে, রেলপথ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে ৭০০ লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় হত্যার পর রেললাইনে লাশ ফেলা রাখা হয়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
লেভেলক্রসিংয়ে মানুষের প্রাণহানি কমাতে হবে। কিন্তু লেভেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। রেলওয়ের তথ্য অনুসারে সারাদেশে মোট রেলক্রসিংয়ের মধ্যে অনুমোদন নেই ১ হাজার ৩২১টির। এসব ক্রসিংয়ের বেশিরভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সড়কে। আরও আছে অন্যান্য সংস্থার যেমন– পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সওজ বিভাগের সড়কে লেভেলক্রসিং রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিংই অরক্ষিত। অবৈধ রেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। এখানে নিরাপদব্যবস্থা বাড়াতে হবে।