গতকাল ২২ অক্টোবর ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। জনসচেতনতা সৃষ্টি ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দেশে সরকারিভাবে প্রথম ২০১৭ সালে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালন করা হয়। কিন্তু সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে বহু মানুষ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। তড়িঘড়ি করে নানা উদ্যোগ নিয়ে সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করা হলেও তা টেকসই হয়নি। ফলে দুর্ঘটনাও কমেনি, ঝুঁকিও রয়ে গেছে পদে পদে। কোনো মতেই যেন শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়ক মহাসড়কে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তদারকিতেও বিশৃঙ্খলা দূর হয়নি। অসংখ্য মামলা ও বিপুল জরিমানার পরও নৈরাজ্য রয়ে গেছে আগের মতোই। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নৈরাজ্য বন্ধে গোড়ায় হাত দেওয়া হয়নি। আগায় পানি ঢালা হয়েছে। এত আন্দোলন, এত মৃত্যুর পরেও পথচারী যেমন সচেতন নয়, তেমনি বেপরোয়া গাড়ির চালকরা। কোনও নিয়মই যেন একরোখা বাঙালির চেতনাকে জাগাতে পারছে না। নিয়ম ভঙ্গই যেন এদেশে ক্ষমতা আর বাহাদুরির বহিঃপ্রকাশ। নগরবাসী ও সংশ্লিষ্ট নগর বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন– নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থী ও দেশবাসীর এত বড় আন্দোলনের সফলতা কি আমরা পাবো না?
গতকাল দৈনিক আজাদীতে ‘সড়ক আর নিরাপদ হলো কই’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২০২২–২০২৩ অর্থবছরে দেশে ৪ হাজার ৫৭৭ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৪ হাজার ৩৭১ জন। এ তথ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। অর্থাৎ নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে গৃহীত সরকারের নানা উদ্যোগের মধ্যেই দেশে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা। জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে। এসব প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যের ওপর নির্ভর করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত বছর সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। সরকারি ও বেসরকারি দুটো প্রতিবেদনে পার্থক্য থাকলেও উভয় প্রতিবেদনে কিন্তু দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি পূর্বের বছরের চেয়ে বৃদ্ধি পায়।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর একটি প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত গতি, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য বোঝাই, অবৈধ প্রতিযোগিতা, হেলমেট ও সিটবেল্ট না বাঁধার প্রবণতা, মাদকদ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালনা, চালকের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, যানবাহনসমূহের যথাযথ পরীক্ষা–নিরীক্ষা না করা, হেলপারের সহায়তায় গাড়ি চালনা, যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়ক ব্যবহারবিধি না জানা ও সচেতনতার অভাব, ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় চলাচল, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, অপর্যাপ্ত রাস্তা ও নিরাপত্তার অভাব এবং যথাযথভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ না করা।
বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু অভিমত প্রকাশ করেছেন পত্রিকান্তরে। এর মধ্যে রয়েছে, ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ সব সময়ের জন্য শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনভঙ্গের দায়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সড়কের উল্টো পথে চলাসহ যাবতীয় রকমের অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। সার্বিক দুঃসহ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে হলে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিতে হবে এবং সেই নীতির শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের মধ্যকার দুর্নীতিবাজ অংশটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতাহীন–ক্ষমতাধর নির্বিশেষে ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘যাত্রীদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কিন্তু সড়কে বাসের চালক–সহকারীরা যদি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় থাকে যাত্রীদের সচেতনতা কোনো কাজে আসবে না।’ তাঁরা বলেন, ‘সড়ক পরিবহন শ্রমিক ও মালিকেরা অন্যায় করে চললেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা চরম উদাসীন। অনেক পরিবহন মালিক কম মজুরিতে অপ্রশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন মানুষ মরছে। সড়ক নামলেই যেন মৃত্যু ওঁৎ পেতে থাকে। এসব বন্ধে সকল সংস্থার সমন্বিত কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।’