বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী সুচারুরূপে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অবাধ–সুষ্ঠু এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক যৌক্তিক ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ। নির্বাচন কমিশন যথার্থ দক্ষতা–যোগ্যতা–নিরপেক্ষতার সক্ষমতায় সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে এটিই কাম্য।
এটি সর্বজনবিদিত যে; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথার্থ ধারণ ও পরিচর্যা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে উন্নয়ন–অগ্রগতির অন্যতম উপাদান। আপামর জনগণের সামষ্টিক চিন্তা–চেতনার উপস্থাপনে বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় অবাধ–সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাই প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার প্রকৃষ্ট পরিচায়ক। মূলতঃ সকল দল–মতের সম্মিলিত অংশগ্রহণ–সমর্থনে নেতৃত্ব বাছাই এবং সঠিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। গণতন্ত্র হলো আধুনিক বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সমাদৃত শাসনব্যবস্থা যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্রই সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। বিপুল পরিবর্তন–পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে বর্তমানেও গণতন্ত্র সমধিক জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে চলছে। গণতন্ত্র যেকোন সমাজে পরিশুদ্ধ পন্থায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনে রাষ্ট্র বা সরকার পদ্ধতিকে নির্দেশিত করে। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের শাসন বা শাসন নীতির ইচ্ছানুসারে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাবলীল ধারণা–ধারাবাহিকতার সুস্পষ্ট বহির্প্রকাশ। গণতন্ত্র সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ, মানুষের স্বাধীনতা–অধিকার নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাসহ সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের ঐতিহ্যিক সৌকর্যের তাৎপর্যপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠান।
দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন–নির্বাচনকালীন সরকার–নির্বাচনের পূর্বে সরকার পদত্যাগের একদফাসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিরোধী দলসমূহের সমাবেশ–মহাসমাবেশ–গণসমাবেশ–পদযাত্রা আয়োজনে সচেতন মহলসহ দেশবাসীর হৃদয়ে অপরিমেয় কৌতুহল–উদ্বেগ নির্মিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধী দলসমূহের একটানা কর্মসূচি এবং সরকারি দলের উন্নয়ন–শান্তি সমাবেশের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট জনদুর্ভোগে মানুষের মনে এক ধরনের উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশের সার্বিক আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশপ্রেমিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও, যেকোন সময় সহিংসতা–নাশকতা ঘটার সন্দেহে জনমনে ভীতি সঞ্চারণ অমূলক নয়। উজ্জীবিত কর্মীদের উদ্দেশ্যে দলীয় নেতাদের উত্তেজক বক্তৃতা–বিবৃতিতে নানা ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজপথে ফয়সালা বা রাজপথ দখল করার হুমকি–ধমকি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। বিরাজিত দেশীয় এবং বৈশ্বিক পর্যুদস্ত অর্থনৈতিক সংকটে যেকোনো দলের অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা জনগণ সহজেই অনুধাবন করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির সব পক্ষকেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী, ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আগামী ২২ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন প্রত্যাশিত। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী এই সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
চলতি মাসে ঢাকা সফরকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির থিংক ট্যাংক হিসাবে পরিচিত দুই সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রাক–নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল দেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসার তাগাদা দিয়েছেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তারা সরকার–রাজনৈতিক দল–নির্বাচন কমিশনসহ অংশীজনদের রাজনৈতিক বিষয়ে পরিমিত বক্তৃতা দেওয়াসহ পাঁচটি সুপারিশ পেশ করেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য চারটি সুপারিশ হলো– মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নাগরিক সমাজের কথা বলার স্থান নিশ্চিত করা যেখানে ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সম্মান দেখানো হবে, নির্বাচন অহিংস হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে রাজনৈতিক সহিংসতার অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় রাখতে হবে, সব দলকে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যার মাধ্যমে স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে, নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সক্রিয় নির্বাচনি অংশগ্রহণের সংস্কৃতির প্রচার করা ইত্যাদি। বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের জনগণই চুড়ান্তভাবে তাদের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্য–বৈধতা এবং দেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন নির্ধারণ করবে। উল্লেখ করার মত বিষয় হচ্ছে; অতীতে অনেকবার দেশি–বিদেশি দূতিয়ালি অনুসরণে সংলাপের কোনো ইতিবাচক ফলাফল অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। বর্তমানেও সংলাপের তেমন কোন ফলদায়ক ইতিবৃত্ত তৈরি হবে সচেতন মহল তা মনে করে না।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার জানান, বাংলাদেশে অবাধ–সুষ্ঠু–শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য মার্কিন প্রাক–নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা অর্থবহ সংলাপসহ যে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছেন সেগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারেরও সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকারকে বাস্তবায়নে সহায়তা করতে এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়া অবিশ্বাস্য মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ।’ এছাড়াও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও নির্বাচন সামনে রেখে চলমান সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আগেই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথে হাঁটার জন্য বড় দুই দলকে এক টেবিলে বসতে বলা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দল, বিরোধীদলগুলোসহ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোও সংকট সমাধানে সংলাপে বসার তাগাদা দিয়েছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনও দুই বড় দলকে আলোচনার টেবিলে বসার অনুরোধ জানিয়েছিল। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, কমিশনের পক্ষ থেকে সংলাপ এবং ইভিএম নিয়ে আলোচনার জন্য বিএনপি এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে একাধিকবার চিঠি দেয়া হলেও কোন সাড়া মেলেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বড় দুই দল এর আগে নানা দফায় সংলাপে বসলেও এর ইতিবাচক ফলাফল কখনো পাওয়া যায়নি। কখনো নিজেরা বা কখনো মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে আলোচনায় বসার পরেও দিনশেষে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দল দুটি যে অবস্থান নিয়েছে, তা পরিস্থিতিকে আরও সংঘাতময় করবে। অতীতে বিভিন্ন কারণে এবং ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে দেশে সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মাসের পর মাস হরতাল–অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে সহিংসতায় বহু প্রাণহানি হয়েছে। দেশজুড়ে নাশকতামূলক কর্মকান্ডে যে ব্যাপক ব্যক্তিগত–রাষ্ট্রীয় সম্পদহানি হয়েছিল, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল অর্থনীতিতে। বর্তমানে নানা সংকটে থাকা দেশের অর্থনীতি রাজনৈতিক সহিংসতায় আরও বাড়তে পারে যা কোনভাবে কাম্য নয়। রাজনৈতিক সংকট দূর করার জন্য আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য–অংশগ্রহণমূলক হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
২৯ আগস্ট ২০২৩ দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে গণবভনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আগামী নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে কি উদ্যোগ নেওয়া হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘অংশগ্রহণটা কার অংশগ্রহণ? আমার কাছে অংশগ্রহণ হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণ ভোট দেবে; সেই ভোটে যারা নির্বাচিত হবে, জয়ী হবে তারা সরকারে আসবে। এখন অংশগ্রহণ বলতে কাদের অংশগ্রহণ? ভোট চোরদের? ভোট ডাকাতদের? দুর্নীতিবাজ, মানিলন্ডারিং, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারী, জাতির পিতার হত্যাকারী, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী তাদের অংশগ্রহণ? এটা কি জনগণ চায়? তারা অংশগ্রহণ করলেই বৈধ হবে আর অন্য কেউ করলে হবে না এটা তো কোন কথা হতে পারে না। যতগুলো উপনির্বাচন হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলো, জনগণ কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেনি? জনগণ তো অংশগ্রহণ করেছে, সেটাই তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো।’
সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, বৈশ্বিক ও দেশীয় রাজনীতির বিরাজিত সংকট খুবই স্পর্শকাতর। অতি সহজে এর থেকে পরিত্রাণ দুরূহ ব্যাপারও বটে। সকল অবিশ্বাস–বিরোধ–বিচ্ছেদ সংহার করে পরমতসহিষ্ণুতা–রাজনৈতিক শিষ্টাচার যথাযথ প্রতিপালনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনমুখী নিখাঁদ আগ্রহ ও প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়চেতা আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভার হয়ে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশাই হবে সম্ভাব্য সমাধান।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।