শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা হোক

| শনিবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

গতকাল শুক্রবার দৈনিক আজাদীতে প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে যেই সংবাদটি ছাপা হয়েছে, সেটি হলো, নতুন কারিকুলামে মুদ্রিত প্রায় দেড় কোটি বই আসতে শুরু করেছে চট্টগ্রামে। বছরের প্রথম দিকেই এসব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হবে। এতে আরো বলা হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বিভাগ বিভাজন তুলে দেয়ায় সব পাঠ্যবই সকল শিক্ষার্থীকেই পড়তে হবে। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে বিজ্ঞান মানবিক কিংবা ব্যবসা শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বিভাজন হবে। নয়া কারিকুলামের আওতায় একেবারে নতুন ধাঁচের জীবনমুখী, পেশামুখী, যুগোপযোগী এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার সাথে সমন্বয় করে নয়া কারিকুলাম তৈরি এবং তার ভিত্তিতে নতুন বই ছাপানো হয়েছে। ৬ষ্ঠ থেকে দশম ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকেই অভিন্ন দশটি বই পড়তে হবে।

বলা অনাব্যশক যে, আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। আজ যে শিশু বেড়ে উঠছে এদের মধ্যেই কেউ কেউ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে দায়িত্ব পালন করে উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আরো গতিশীল, সমৃদ্ধ করে তুলবে। এর জন্য শিশু সহায়ক যে পরিবেশের প্রয়োজন সেটি আমরা কতটা দিতে পারছি তা ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমানে শিশুরা যে পরিবেশে বেড়ে উঠছে বিশেষ করে শিক্ষার পরিবেশ তাদের অনুকূলে নেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বইয়ের বোঝা। মগজে পড়া মুখস্থ করার চাপ। সকাল থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত শিশুকে পড়াশোনার চাপ মাথায় নিয়ে কাটাতে হচ্ছে। অথচ এতটুকু বয়সে এই শিশুদের এত চাপ নেয়ার কথা নয়। তারা বেড়ে উঠবে হেসে খেলে এবং আনন্দের মাঝেই তারা গ্রহণ করবে প্রয়োজনীয় শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, শিশু বইয়ের বাইরে এবং ভালো ফলাফল ছাড়া আর কিছু ভাবনায় নিতে পারছে না। মেধা মূল্যায়নে প্রাথমিক স্তর শেষে পিইসি নামক আরেক ভয়ঙ্কর দায় চাপিয়ে তাদের মনোবিকাশও বাধাগ্রস্ত করে রাখা হয়েছে। বিশিষ্টজনরা মনে করছেন প্রাথমিক স্তরে শিশুর জন্য কোনো পরীক্ষা নেয়ারই দরকারই নেই। তারা পড়বে, খেলবে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নেবে। শিল্পকলা একাডেমির ‘সহজপাঠ : শিশুর সামগ্রিক বিকাশ’ শীর্ষক এক আলোচনা চক্রে যোগ দিয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ তুলে ধরার পাশাপাশি প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির সমালোচনা করেছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

শিশুদের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে ‘আনন্দযোগ নেই’ এমন অভিযোগ তুলেছেন তিনি। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যা হচ্ছে তা শিশুদের পরীক্ষার নামে রীতিমতো মানসিক পীড়ন। শিশুরা পড়ছে, পড়া মুখস্থ করছে, ভালো ফল করছে। কিন্তু এতে শিক্ষার মূল যে গাম্ভীর্য, যে উদ্দেশ্য তা মারাত্মভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ভালো ফলের প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেই বিভাজন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তুলনামূলক কম মেধাবীরা হীনম্মন্যতার শিকার হচ্ছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জ্ঞানার্জনের কোনো সম্পর্ক নেই। পরীক্ষাসর্বস্ব শিক্ষা জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক করে ফেলছেএমন অভিযোগও সুস্পষ্টভাবে উঠেছে বক্তাদের আলোচনায়। এসব অভিযোগ যে অসত্য নয় তা নতুন করে বলার কিছু নেই। সময় এসেছে শিক্ষার এই অপ্রয়োজনীয় চর্চা বদলের। শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শিশুকালে শিশুকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা না গেলে অনিয়ম, দুর্নীতি, অমানবিকতা থেকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কখনো মুক্ত হতে পারবে না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে গঠিত কুদরতখুদা শিক্ষা কমিশন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘নৈতিক শিক্ষা’কে অগ্রাধিকার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর তা আর অনুসরণ করা হয়নি। আমরা চাই, শিশুরা বেড়ে উঠুক শিশুদের মতো। তাদের চিন্তা করার স্বাধীনতা দেয়া হোক। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিবেশ তৈরি করা হোক যে পরিবেশ তাদের মেধা বিকাশে সহায়ক হবে।

জানা গেছে, গণমুখী, জীবনমুখী, পেশামুখী এবং বাস্তবভিত্তিক একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়নের যে অ্যাকশন প্ল্যান তারই ধারাবাহিকতায় এই নতুন বই। মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতীয়তাবোধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শনভিত্তিক শিক্ষায় একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে বইগুলো প্রণীত হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন না থাকায় সব শিক্ষার্থীকেই এসব বই পড়তে হবে বলেও জানা গেছে। আমরা চাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ যুগে শিক্ষার্থীরা আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করুক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে