পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়লেও কমে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি সাড়ে ৫ হাজার কোটির বেশি টাকা কমে গেছে। অবশ্য তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপীয় দেশ, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় রপ্তানি বেড়েছে। তবে এককভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যের সর্ববৃহৎ বাজার আমেরিকায় রপ্তানি কমে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস সেক্টরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিজিএমইএ ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। দেশ হিসেবে আমেরিকাই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের ভালো–মন্দের অনেক কিছুই আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। আমেরিকা বছরে প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক কিনে বাংলাদেশ থেকে। বিশাল এই বাজারে পণ্য রপ্তানি কমছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন কোয়ার্টারে আমেরিকায় মোট ৪ হাজার ৫৭৭ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন কোয়ার্টারে রপ্তানি হয় ৪ হাজার ১০৬ দশমিক ১৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি কমেছে ৪৭১ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। গত বছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানির ২৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ রপ্তানি হয়েছিল আমেরিকায়। চলতি বছরে তা কমে নেমে আসে ২৬.০৪ শতাংশে। পোশাক রপ্তানি এভাবে কমে যাওয়া গার্মেন্টস কারখানার মালিকদের শঙ্কিত করেছে। তারা বলছেন, দিন দিন পণ্যের চাহিদা বাড়ে। পুরো পৃথিবীতে পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। আমাদের রপ্তানিও বেড়েছে। কিন্তু আমেরিকায় কমে যাওয়া শুভ লক্ষণ নয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের একই সময়কালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে ৬ হাজার ৪৫৪ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একই সময়কালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩৫৭.০৭ মিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে ৯৭ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ডলার।
চলতি বছরের একই সময়কালে যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৬৪৭.৩১ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। আগের বছর একই সময়কালে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৪৬৪ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে ইংল্যান্ডে রপ্তানি বেড়েছে ১৮২.৬১ মিলিয়ন ডলার।
তৈরি পোশাকের অপর বড় বাজার কানাডায়ও পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কানাডায় পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৫৩৯ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৬২২ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানি বেড়েছে ৮৩ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার।
পৃথিবীর দেশে দেশে রপ্তানি বাড়লেও আমেরিকায় কমে যাওয়ার ব্যাপারটি কাকতালীয় বলে মন্তব্য করছেন দেশীয় শিল্পোদ্যাক্তাদের অনেকে। তারা বলছেন, আমেরিকার তৈরি পোশাকের বাজারের সাথে দেশের অন্য কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই। আমেরিকার ক্রেতারা চাহিদা না থাকায় পোশাকের অর্ডার দেননি। তাদের স্টকে গত বছরের বেশ কিছু পণ্য রয়ে গেছে। যেগুলো তারা এই বছর বিক্রি করবে। আবার আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদাও কমেছে। যার ফলে তারা অর্ডার কমিয়েছে। বিষয়টি শুধু বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে নয়, চলতি বছর আমেরিকা চীন ও ভিয়েতনাম থেকেও তৈরি পোশাক আমদানি কমিয়ে দিয়েছে।
আমেরিকায় রপ্তানি কমলেও সার্বিকভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বছরের প্রথম তিন কোয়ার্টারে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। গত বছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশ মোট ১৫ হাজার ২৮৪ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল। চলতি বছর যা ১৫ হাজার ৭৭১ দশমিক ৩১ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রপ্তানি বেড়েছে ৪৮৬ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলার। টাকার অংকে যা প্রায় পৌনে ৬ হাজার কোটি টাকা।
আমেরিকায় তৈরি পোশাকের অন্যতম রপ্তানিকারক প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, আমেরিকা ও জার্মানি আমাদের পোশাকশিল্পের প্রধান বাজার। এই দুই বাজারেই রপ্তানি কমেছে। তবে সার্বিকভাবে রপ্তানি বেড়েছে অপ্রচলিত বাজারে। আমেরিকায় রপ্তানি শুধু যে বাংলাদেশ থেকে কমেছে তা কিন্তু না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রপ্তানিকারক দেশগুলোর রপ্তানি আমাদের তুলনায় আরো বেশি কমেছে। আমি মনে করি, আগামী বছর এই পরিস্থিতির উন্নতি করবে।
এ ব্যাপারে বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমেরিকান ক্রেতারা অর্ডার কমিয়েছে। এটি আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। অন্যান্য দেশে রপ্তানি বাড়ায় আমেরিকায় কমে যাওয়ার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা হয়তো কিছুটা সম্ভব হবে। তবে সার্বিক প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর সরকারি–বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বিদেশি দূতাবাসগুলোকে বাজার সৃষ্টিতে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান।