হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরেও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এত টাকা ব্যয় করার পরেও কেন জলাবদ্ধতা হবে? এটা আমাকে যন্ত্রণা দেয়। বারবার দগ্ধ হই। কী কাজ হচ্ছে তার আউটপুট চাই। শুধু মিটিং করলাম, রেজুলেশন করলাম; এগুলো শুনতে শুনতে বিরক্ত। জলাবদ্ধতা নিয়ে কোনো স্টাডি বা সমীক্ষা আছে কি আপনাদের?
এই কথাগুলো চট্টগ্রামের কোনো মন্ত্রীর নয়। চট্টগ্রামের কোনো শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারও নয়। এঁরা চট্টগ্রামের নাগরিক ইস্যু নিয়ে খুব বেশি কথা বলেন না। কোনো সমস্যা নিয়ে উচ্চকিতও হন না। এরা বিএনপিকে গালাগাল করা ছাড়া দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য, মশকনিধনে ব্যর্থতা, ভেজাল, নকল, অর্থাৎ নাগরিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেন না। জনগণের কাতারে এসে তাদের দুঃখ–বেদনার কথা জানতেও চান না। এবারও এসব তাঁরা বলেননি, বলেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উন্নয়ন কার্যক্রম সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন। সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো সেনাদানকারী সংস্থার ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অতীতে বেশকিছু সমম্বয়সভা হয়েছে সেখান থেকে ফলপ্রসূ কোনো উপায় বের হয়ে আসেনি। এ সময় তিনি চসিক রাজস্ব খাতে যে আয় করে এবং মশক নিধন খাতে যে ব্যয় করে তার হিসাব চান। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব আয় থেকে খাল রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলেও চসিক কেন পারছে না সে প্রশ্ন তোলেন। এ সময় তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, অর্থাৎ বন্দর থেকে কর্পোরেশনের জন্য প্রস্তাবিত রাজস্ব আদায়ে চসিককে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন। এই দাবিটি অযৌক্তিক নয়। বন্দর কর্তৃপক্ষের আয় থেকে অন্তত ১ শতাংশ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে প্রদান করার দাবিটি বিভিন্ন স্তরে আলোচিত হলেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কখনও আলোচনার উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আইনু২০২২ এর খসড়ায় বন্দরের মোট আয়ের এক শতাংশ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে প্রদানের বিষয়ে প্রস্তাবনা হিসেবে থাকলেও পরবর্তীতে চূড়ান্ত আইনে তা সন্নিবেশিত হয়নি। এটা খুব দুঃখজনক।
মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালীন এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনিও এই দাবি করতেন। আ, জ, ম নাসিরউদ্দিন মেয়র থাকাকালে তাঁর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল তিনি বলেছিলেন, আপনারা নাগরিকদের পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তুলুন। এখন তো কোনো নাগরিক আন্দোলন নেই। জনগণের কথা শোনার, জনগণের পক্ষে বলার কোনো নেতা নেই। খোরশেদ আলম সুজন ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক নেতা জনগণ ভালো আছে কিনা সে খবরও রাখে না। জনগণের দাবি নিয়ে আগে সোচ্চার থাকত কমিউনিস্ট পার্টি তাদেরও এখন রাজপথে দেখা যায় না খুব। বিএনপি তো সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি ছাড়া জনগণের কোনো দাবি নিয়ে আন্দোলন করে না। ওদের আন্দোলন খালেদা জিয়া, তারেক রহমান আর নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতেই সীমাবদ্ধ।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের চেষ্টার বিষয়ে অভিযোগ আছে, ওরা ঠিকভাবে করছে না। সময় পেলে আমি নিজেও কয়েক জায়গা ভিজিট করতাম। এজন্য তো আমরা আপনাদের টাকা দিই। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে অত টাকা দিই। এখন আপনার কোথায় কীভাবে খরচ করেন বলেন। কেন এডিস মশা মানুষকে কামড়াবে? হ্যাঁ, ঢাকাতে ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। ব্রাজিলে একদিনে ১১ হাজার আক্রান্ত হয়েছে। পরশু ঢাকা সিটিতে হয়েছে ৫৬৯ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হয়েছে চট্টগ্রাম শহর। চট্টগ্রামে আমরা কী করি? সকল নাগরিক যদি স্ব স্ব বাড়িটা পরিষ্কার রাখে, এডিস মশা তো হবে না। তিনি বলেন, আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, আমাদের দায়িত্বটা পালন করছি?
এ ধরনের সভা আগেও হয়েছে তবে এবারের মতো এত খোলামেলা কথা সরকারের মন্ত্রী পর্যায় থেকে বলা হয়নি। কিন্তু বলা হলো সরকারের শেষ পর্যায়ে। দুয়েক বছর আগে বললেও তার কিছু প্রতিফলন দেখা যেত।
সিটি করপোরেশন কতটা স্থবির তার একটি উদাহরণ দিই। ৩ অক্টোবর একটি স্থানীয় দৈনিকে ‘মেয়র সমীপে‘ শিরোনামে একটা আবেদন করেছিলাম মেয়র বরাবর। সে আবেদনে কদম মুবারক মসজিদের দুই ফটকের অরাজক অবস্থা, পূর্ব ফটকে সিঁড়ি পর্যন্ত ময়লার স্তুপ, আশেপাশে ডাস্টবিন অর্থাৎ ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি রক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মেয়রের সুদৃষ্টি আশা করেছিলাম। এই নিবেদন মেয়র পর্যন্ত পোঁছেছে কিনা জানি না তবে ময়লা–আবর্জনার পরিমাণ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি অন্তত দশ বছর ধরে কদম মুবারক মসজিদ সংলগ্ন এলাকা, কদম মুবারক বাইলেইন সংস্কার না করা, পরিষ্কার না করা, স্কুলগেইটের পাশে ময়লার স্তূপ ফলে না রাখার আবেদন জানাতে জানাতে ক্লান্ত হলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
মেয়র হলেন একজন নগরপ্রধান। তাঁর উচিত নগরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে বাস্তব পরিস্থিতি নিজ চোখে অবলোকন করা। তিনি যদি প্রতিশুক্রবারের জুমার নামাজটা একেক মসজিদে আদায় করতেন তাহলেও বছরে এভাবেই অন্তত অর্ধ শত এলাকা পরিদর্শন ও এলাকার জনগণের সুখ–দুঃখ, অভাব–অভিযোগ শোনার সুযোগ পেতেন। মশক নিধনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারার প্রসঙ্গ তুলে সভায় মন্ত্রী মেয়রের উদ্দেশে বলেন, চট্টগ্রামে আমরা কী করি? মেয়রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আরে ভাই, আপনি যদি একবার হেঁটে যান তখন মানুষের মধ্যে একটা মুভমেন্ট সৃষ্টি হবে। এই কাজগুলো কি আমরা করি? আপনার সকল নাগরিক যদি স্ব স্ব বাড়িটা পরিষ্কার রাখে, এডিস মশা তো হবে না। তিনি বলেন, আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, আমাদের দায়িত্বটা পালন করছি?’
মহিউদ্দিন চৌধুরীর সামনে কোনো উদাহরণ না থাকলেও মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এনে সফল হয়েছিলেন। তিনিই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ‘সেবক‘ নাম দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রেও তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছিলেন। পরিচ্ছন্নতার চিত্র প্রতিদিন নগরবাসী সরাসরি প্রত্যক্ষ করছেন। শিক্ষাসেবা কোনোভাবে টিকে থাকলেও স্বাস্থ্যসেবা বলে এখন তেমন কিছু নেই।
সিটি করপোরেশনে অর্থের অভাব আছে সেটা সত্য। সীমাবদ্ধতাও অনেক। মেয়র থাকাকালে আ, জ, ম নাছির একবার বলেছিলেন টাকার অভাবে বেতন দিতেও মাঝেমধ্যে হিমসিম খেতে হয়। ওয়াসা থেকে টাকা পাওয়ার পরে বেতন পরিশোধ করেছেন এমন নজিরও আছে। বর্তমান মেয়রসহ এক কাউন্সিলর মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন করপোরেশনের আয়বর্ধক কিছু প্রকল্প দেওয়ার। দাবিটি যৌক্তিক। এটার জন্য বন্দর থেকে অন্তত এক পারসেন্ট সার্ভিস চার্জ আদায় করার সুযোগ পেলে সিটি করপোরেশনের আর্থিক সমস্যা অনেকটা কেটে যেত। তবে যার ক্ষুধা তাকেই তো বলতে হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো আগে সিদ্ধান্ত দিয়েছি। তখন বন্দর চেয়ারম্যানও ছিলেন। আপনারা আদায় করেন না কেন? আদায় করার বহু পথ আছে। আমি কী সব কথা এখানে বলে দেব নাকি? আপনার রেভিনিউ ইনকামের জন্য আপনি চিন্তা করবেন না? এজন্য যে ধরনের এফোর্ট দেওয়া দরকার, তা আপনি করবেন না? আপনারা রাস্তা ব্যবহার করে, তাতে বছরে হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, এগুলো মেটাবে কোত্থেকে?’
মন্ত্রী বলেন, ‘বন্দর চেয়ারম্যানকে বলেন। যদি এটা না হয়, বলেন, রাস্তাঘাট তো অনেকে বন্ধ করে দিয়েছে। আমিও বন্ধ করে দেব। আপনারা আমার মুখ দিয়ে কথা বলাতে চাইছেন কেন? উদ্দেশ্য হলো, আপনারা ভেতরে ভেতরে সব ঠিক থাকবেন। আপনার রাস্তা ব্যবহার করে, আপনারা রাস্তা ব্যবহার করতে দিলেন কেন? আপনারা চেয়ারম্যানের কাছে মেয়রসহ একবার গিয়ে বলেন। ধরেন না কেন? যুক্তিতে আসেন। মিডিয়াতে যান, প্রেস হোক, সবাই জানুক। স্বাভাবিকভাবে সরকার যে সাপোর্ট দরকার দেবে।‘
৩ অক্টোবর অন্য একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ছিল এমন, ‘আবাসন সংকট নিরসনে ২০১৭ সালে ‘অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। প্রকল্পটির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবসহ ৫ কর্মকর্তা। এতে সিডিএর ব্যয় হয় ১ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বেশি। অথচ সিডিএ এখন বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়! প্রকল্পটি বাতিল করতে চিঠিও পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এভাবে সিডিএর ছয়টি প্রকল্পের অধীনে ৩৪ জনের বিদেশ সফরের তথ্য মিলেছে সমকালের অনুসন্ধানে, যাদের ২৩ জনই প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। বিদেশ সফরকারীর ওই তালিকায় রয়েছেন সিডিএর বোর্ড সদস্য, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি। তারা যুক্তরাষ্ট্র–কানাডাসহ ১৪টি দেশ সফর করেন। এসব সফরের খরচ বহন করে সিডিএ এবং পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে এসব সফর হলেও এগুলো মূলত ছিল ‘আনন্দ ভ্রমণ’, যার মাধ্যমে বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে। অথচ অনেক প্রকল্পের বাড়তি খরচ মেটাতে সিডিএ আরোপ করছে টোল।‘ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবারই বলছেন কৃচ্ছসাধনের কথা। সেজন্য তিনি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর বিদেশ যাত্রা একেবারে সীমিত করতে বলেছেন। এটা কোন কৃচ্ছতার লক্ষণ তা জনগণ বুঝতে পারছে না।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীনে যে খালগুলো আছে সেগুলো এখনও অসমাপ্ত অবস্থায় আছে। এর বাইরে যে খালগুলো আছে তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সে খালগুলো ভরাট হয়ে রাস্তার সমান হয়ে গেছে। গত অন্তত দশ বছরে সেসব খাল থেকে এক কোদাল মাটিও সরায়নি সিটি করপোরেশন। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। টাকার অভাবে আরও অনেক কাজ বাকি আছে। সেসবের কী হবে শেষ পর্যন্ত? আমি শুরু থেকে বলেছিলাম ভুল পথে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলপ্রসূ তেমন কিছুই হবে না। বরং খালের মুখে স্লুইচগেটগুলো গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দেবে অচিরেই।
লেখক : কবি–সাংবাদিক