সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিউনিসিপাল মডেল স্কুল ও কলেজ মাঠে গত ১৪ অক্টোবর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সপ্তাহব্যাপী চট্টগ্রাম বিভাগীয় বইমেলা শুরু হয়েছে, শেষ হবে ২০ অক্টোবর। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে খুব অবাক হলাম। বড় অচেনা লাগছে এলাকাটিকে। নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এটাকি গতকাল দেখা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিউনিসিপাল মডেল স্কুল প্রাঙ্গণ যা আগেরদিন আমরা চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ কর্মকর্তাবৃন্দ বইমেলার স্টলের প্রস্তুতি পর্ব দেখতে গিয়েছিলাম। অবাক হয়েছে স্টল বরাদ্দ পাওয়া ঢাকা–চট্টগ্রামের সকল প্রকাশকবৃন্দও। রাতারাতি এ কি পরিবর্তন। মনে পড়ে ১৯৬৮ সালের কথা। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে তৎকালীন কুমিল্লা বোর্ডে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম বন্দর হাই স্কুলের আসন পড়েছিল এই স্কুলে। স্কুলটি পুরাতন হলেও সদ্য নতুন ভবনের দোতলায় আসন পড়েছিল আমাদের। প্রতিযোগিতামূলক মাধ্যমিক পরীক্ষা। চরম উত্তেজনার মধ্যে স্কুলটির বিশাল খেলার মাঠ এবং স্কুলের সম্মুখের সুপরিসর রাস্তা দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তার কিছুদিন আগে চুনার গুদাম খ্যাত জায়গায় সিডিও নির্মাণ করেছে বিশাল পরিসর নিয়ে চট্টগ্রামের প্রথম শপিং মার্কেট ‘বিপনি বিতান‘। সেটি নিউ মার্কেট নামে পরিচিতি লাভ করেছে। কলেজিয়েট স্কুলের কাছে হওয়াতে নিয়মিত আসা যাওয়া করতাম। বিপনি বিতানের দোতলায় ডায়মন্ড রেস্টুরেন্টের ‘বোম্বাই টোস্ট‘ আর ‘চিকেন কাবাবের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও পরীক্ষা চলাকালীন সময় সেই সুযোগটা নিয়েছিলাম। প্রতি বিষয়ের দুই বেলা পরীক্ষার ১ ঘণ্টা বিরতিতে ডায়মন্ড রেস্টুরেন্টে ঢু মেরেছিলাম। প্রিয় খাবারগুলোর স্বাদ গ্রহণ করেছিলাম। পরবর্তীতে নিউ মার্কেটের রাস্তা দিয়ে যাওয়া–আসার সময় স্মৃতি বিজড়িত স্কুলটিকে দেখতাম। মহান স্বাধীনতার পরবর্তী সময় স্কুলটি হয়ে উঠেছিল সাহিত্য ও শিক্ষা বিষয়ক মেলার আয়োজনের প্রধান স্থান হিসেবে। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামে সেখানে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন অত্যন্ত সফল একটি বইমেলার আয়োজন করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিল। তারপর চলতে থাকে প্রতিবছর বিজ্ঞানমেলা ও অন্যান্য মেলা। বিজ্ঞানের ছাত্র ও চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আমার বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে স্কুলটিতে। সময় গড়িয়ে সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। স্কুলটি আর দেখা যায় না, চেনা যায় না। স্কুল ঘেঁষে ক্রমান্বয়ে আনাগোনা শুরু হলো হকারদের। বছর বছর তাদের সংখ্যা বাড়তেও লাগলো। প্রশাসনের নীরবতা ও স্বার্থান্বেষী মহলের সহযোগিতায় দিন দিন তা হয়ে উঠলো জমজমাট বর্ধিত হকার মার্কেট হিসেবে। ফুটপাথে দোকান ঘরও নির্মাণ করা হলো। এখন শুধু ফুটপাথ নয়, রাস্তার অর্ধেকাংশও তারা দখল করে নিয়েছে। সে সঙ্গে বসেছে অসংখ্য খাবারের দোকান। স্কুল প্রাঙ্গণের পরিবেশ আর রইলো না। এবারের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বইমেলা–২০২৩ এর প্রস্তুতি সভায় চট্টগ্রাম প্রকাশক পরিষদ এর পক্ষ থেকে আমি প্রস্তাব করেছিলাম স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানে বইমেলাটি আয়োজন করার জন্য। (এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সম্প্রতি চট্টগ্রামে অমর একুশে বইমেলা সফল আয়োজনের স্থান চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক খেলাধুলার স্বার্থে সকল মেলা আয়োজন নিষিদ্ধ করেছে)। অবশ্য আমাদের প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো দাবি ছিল স্কুলের সম্মুখে ফুটপাথ ও রাস্তাকে হকারমুক্ত করতে হবে। নতুবা এখানে বইমেলা সফল হবে না। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসন আমাদের দাবীকে মেনে নিয়ে আশ্বস্ত করেছেন এবং বিভাগীয় বইমেলা– ২০২৩ শুরুর দিন তার বাস্তবায়নও আমরা লক্ষ্য করেছি। বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমেদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। বাংলাদেশ গণ–গ্রন্থাগারের পরিচালক কবি মিনার মনসুর, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম হোসেন, সিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এম এ মাসুদ, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কবি আবদুল মালেক। চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ এবং আমি চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু।
মঞ্চে সূচনা বক্তব্যে আমি বইমেলা চমৎকার আয়োজনের পাশাপাশি ফুটপাথ ও রাস্তাকে হকারমুক্ত, খাবার দোকান এবং স্থায়ী দোকান উচ্ছেদ করায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষকে একজন মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম শহরের একজন নাগরিক হিসেবে প্রশাসনকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছি।
আমি বক্তব্যে আরো অনুরোধ করছি চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবী, শুধু–চট্টগ্রাম বিভাগীয় বইমেলা ২০২৩ চলাকালীন সপ্তাহব্যাপী নয় সম্পূর্ণ স্থায়ীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এলাকাটি হকারমুক্ত ও যানজটমুক্ত রাখাটা যেন বইমেলার পরও অব্যাহত থাকে। কারণ এ এলাকাটি চট্টগ্রাম শহরে মধ্যস্থিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। এখান থেকে গণ–পরিবহণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের সকল প্রান্তে যাওয়া আসা করা যায়। এ জায়গাটি চট্টগ্রাম শহরের মূলকেন্দ্রও বটে। আশেপাশে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়সহ অনেকগুলো স্কুল কলেজ রয়েছে।
আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিউনিসিপাল মডেল স্কুল ও কলেজ সহ চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট (বিপনি বিতান) এলাকাটি স্থায়ীভাবে হকার ও যানজট মুক্ত করা হোক। আমি বিশ্বাস করি প্রশাসনের সদিচ্ছায় তা অবশ্যই বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রয়োজনে হকারদেরকে অন্য কোনও স্থানে পুনর্বাসিত করা যেতে পারে। অবাধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারী সুন্দরী চট্টগ্রামের যেন কোন অবস্থাতেই সৌন্দর্যহানি না ঘটে এ প্রত্যাশা চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও ছাত্র সমাজের। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিউনিসিপাল মডেল স্কুল ও কলেজের প্রাঙ্গনে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু ল‘ টেম্পল সহ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অগণিত কমলমতি ছাত্ররা সুন্দর একটি পরিবেশে তাদের শিক্ষা লাভ করতে চায়। নিউ মার্কেট এলাকাকে আংশিক হকারমুক্ত ও যানজটমুক্ত করার জন্য প্রশাসনকে আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, প্রকাশক, সংগঠক ও সিনেট সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।