অবরুদ্ধ গাজায় আল–আহলি হাসপাতালে গত মঙ্গলবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ অন্তত পাঁচশ মানুষ নিহত হওয়ার পর স্তম্ভিত হয়ে গেছে বিশ্ব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নেতারাও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি রিচার্ড পিপারকর্ন বলেছেন, মাত্রার দিক থেকে এই হামলা নজিরবিহীন। আমরা অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের স্বাস্থ্যসেবার ওপর ধারাবাহিক হামলা দেখছি।
তিনি জানান, গাজার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর ওপর এ পর্যন্ত ৫১ বার হামলা চালানো হয়েছে, আর তাতে ১৫ স্বাস্থ্যকর্মী নিহত ও ২৭ জন আহত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক আহমেদ আল মান্ধারি জানান, আল–আহলি আল–আরাবি হাসপাতালে যখন হামলা চালানো হয় তখন সেখানে রোগী, স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত লোকজনও ছিল। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গাজা ভূখণ্ডের উত্তরাঞ্চলের যে ২০টি হাসপাতাল থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিতে বলেছিল এটি তার একটি। তিনি আরও বলেন, চলমান নিরাপত্তাহীনতা, অনেক রোগীর সঙ্কটজনক অবস্থা, অ্যাম্বুলেন্স, কর্মী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিছানা সক্ষমতা এবং বাস্তুচ্যুতদের বিকল্প আশ্রয়ের ঘাটতির মধ্যে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার এই আদেশ পালন করা অসম্ভব ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েলের ধারাবাহিক বিমানহানা এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে বাঁচতে বহু মানুষ আল–আহলি হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বহু মহিলা এবং শিশু। তারা কল্পনাও করতে পারেননি অ্যাংলিকান গির্জার মালিকানাধীন ওই হাসপাতালে মঙ্গলবার রাতে আছড়ে পড়বে ক্ষেপণাস্ত্র! তেল আবিব উত্তর এবং মধ্য গাজার বাসিন্দাদের বাড়ি ছাড়ার ‘চরম সময়সীমা’ দেওয়ার পরে ওই হাসপাতালকেই ‘নিরাপদ’ ভেবেছিলেন তারা। হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে গতকাল দিনভর চলেছে দোষারোপের খেলা। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র চিকিৎসক আশরাফ আল কুদরা হাসপাতালে হামলার জন্য সরাসরি ইসরায়েল সেনাবাহিনিকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আঙুল তুলেছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের দিকে। তবে প্রথমে ঘটনার জন্য হামাসকে দায়ী করলেও পরে তাদের নিশানা ‘প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ’ (পিআইজে) নামে একটি গোষ্ঠী। হাসপাতালে বিমান হামলার পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল মুখপাত্র একটি পোস্টে লিখেছিলেন-‘ওই হাসপাতালের পাশে হামাসের ডেরা রয়েছে’। পরে সেই পোস্টটি মুছে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে গতকাল দিনভর ইসরায়েল প্রমাণ করতে চেয়েছে, শনিবার রাতে পিআইজের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আঘাত করেছে হাসপাতালে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গতকাল তেল আবিবে পৌঁছেই নেতানিয়াহু সরকারের সেই তত্ত্ব সমর্থন করেছেন। নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে বাইডেন বলেন, আমি যা দেখেছি, তার ভিত্তিতে বলছি, মনে হচ্ছে এটা (গাজার হাসপাতালে হামলা) অন্য কোনও দল করেছে। তার পরই নেতানিয়াহুর দিকে তাকিয়ে তার উদ্দেশে বাইডেন বলেন, ‘আপনি নন’। একাধিক পশ্চিমী দেশও হাসপাতালে হামলা নিয়ে ‘ক্লিন চিট’ দিয়েছে ইসরায়েলকে। প্রশ্ন তোলেনি, কেন গত ১২ দিন ধরে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারের ভূখণ্ডে কয়েক হাজার টন বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হেনেছে তেল আবিব।
তবে পশ্চিম এশিয়ার একাধিক দেশ অভিযোগের আঙুল তুলেছে নেতানিয়াহু বাহিনীর দিকেই। পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, হামলায় যে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে, তা বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র পিআইজের হাতে নেই।
হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ বলেছে, এটি গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, গাজার আল–আহলি আল–আরাবি হাসপাতালে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর বিমান হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে প্রধানত নারী ও শিশুসহ শত শত নিরাপরাধ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এই নির্মম হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান মুসা ফাকি মাহামাত এই হামলার পর ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি এঙ হ্যান্ডলে লিখেছেন, গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলায় নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেন, গাজায় হাসপাতালে হামলা অযৌক্তিক এক ট্র্যাজেডি। তিনি আন্তর্জাতিক মানবিক হস্তক্ষেপ এবং এই অঞ্চলে যুদ্ধবিরতির জন্য তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। এঙ হ্যান্ডলে তিনি লেখেন, নিরপরাধরা যুদ্ধের উন্মাদনার মূল্য দিতে পারে না।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো হামলার নিন্দা করেন এবং যুদ্ধের আইন মেনে চলার ওপর জোর দেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গাজা থেকে যে খবর আসছে তা ভয়ঙ্কর এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য… আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া দরকার এবং সব ক্ষেত্রেই। যুদ্ধের নিয়ম আছে। হাসপাতালে হামলা অগ্রহণযোগ্য। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, গাজায় হাসপাতালে হামলার ঘটনায় তারা শোকাহত। তারা এই হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। মিশর সরকার এই হামলার নিন্দা করে কঠোর ভাষায় একটি বিবৃতি জারি করেছে। পাশাপাশি দেশটি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে পদক্ষেপ নিতে এবং আইনের আরও লঙ্ঘন প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল–সিসি ইচ্ছাকৃত বোমা হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসও (আইসিআরসি) এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলছে, হাসপাতালগুলো মানুষের জীবন রক্ষার জন্য অভয়ারণ্য হওয়া উচিত, মৃত্যু ও ধ্বংসের দৃশ্য নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিমান হামলাকে নিরস্ত্র ও অরক্ষিত মানুষদের ওপর হামলা বলে নিন্দা করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি গতকাল সরকারি শোক ঘোষণা করে বলেছেন, হাসপাতালে হামলা ইসরায়েল এবং তার মার্কিন মিত্রদের বিরুদ্ধে যাবে। তিনি আরও বলেন, গাজার হাসপাতালে আহত ফিলিস্তিনিদের ওপর ফেলে দেওয়া মার্কিন–ইসরায়েল বোমার অগ্নিশিখা শীঘ্রই ইহুদিবাদীদের গ্রাস করবে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল–সুদানি গাজায় আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে অবিলম্বে এবং জরুরি রেজল্যুশন আহ্বান করেন। ইরাক সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে।