গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা; কুতবুল আলম সুলতানুল আউলিয়া আলহাজ্ব শাহ সুফি হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মজিদ (রহ.)। তিনি ১৯৪৪ সালে তাঁর পীর ছাহেব আজমগড়ী হযরত থেকে খেলাফত লাভ করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ অক্টোবর ইন্তেকাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ বছর মানবের কল্যাণে যে খেদমত করে গেছেন তা একালে শিক্ষণীয় অনুকরণীয়। বিশেষ করে একালে দেশের হাজার হাজার পীর ছাহেবের জন্য অনুকরণীয় অনুসরণীয় বলে মনে করি।
গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা ১৯৫০ এর দশক থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫/২৬ বছর ছিলেন এই অঞ্চলের সকল আকিদা মতাদর্শের নিকট অতি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব।
যেমন: আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়দ আবদুল হামিদ বোগদাদী, হযরত সৈয়দ আবদুল কাদের ছাদেক হযরত বড় হুজুর কেবলার সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন। গারাংগিয়া মাদ্রাসার সভায় সে সময় প্রতিকূল যোগাযোগেও তাশরীফ রাখতেন।
আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা আবদুল করিম মাদানী একনাগাড়ে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে ইন্তেকাল করলে সরকারের সহযোগিতায় পবিত্র মদিনায় নিয়ে দাফন করা হয়। তিনি সেসময় প্রতিকূল যোগাযোগেও গারাংগিয়া যাওয়া আসা করতেন। মাদরাসার সভায়ও একাধিক বার তশরিফ নেন। পরবর্তীতে হযরত সৈয়দ আবদুল আহাদ আল মাদানী (রহ.) স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ১৯৯৫ সালে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত নিয়মিত গারাংগিয়া যাওয়া আসা করতেন। হযরত বড় হুজুর কেবলা পরবর্তীতে হযরত ছোট হুজুরের প্রতি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন।
সুন্নি জগতের প্রাণ পুরুষ শেরে বাংলা হযরত শাহ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) অত্যধিক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন আশেকে রসুল। গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুরের প্রতি অত্যন্ত সম্মান রাখতেন। অনেক মাহফিলে হযরত বড় হুজুর সভাপতি হযরত শেরে বাংলা ওয়ায়েজ থাকতেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন।
পটিয়া আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া জমিরিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা দেশখ্যাত মুফতি হযরত মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলাকে অত্যধিক সম্মান ও মূল্যায়ন করতেন। তিনি বিভিন্ন মাহফিলে নসিহতে হযরত বড় হুজুুর কেবলার তারিফ করতেন। একাধিক মাহফিলে যৌথভাবে ছিলেন। তিনি ১৯৬০ সালে ইন্তেকাল করেন।
বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত আলহাজ শাহ মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতার (রহ.) গারাংগিয়ায় নিয়মিত যাওয়া আসা করতেন। ১৯৭০ সালে হজের সময় মিনায় ইন্তেকাল করেন।
বায়তুশ শরফের প্রাণপুরুষ বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হযরত শাহ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.) গারাংগিয়া বড় হুজুরের সরাসরি ছাত্র হতে পেরে নিজেকে গর্ববোধ করতেন।
খতীবে আজম হযরত মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) দেশখ্যাত ওয়ায়েজ। গারাংগিয়া বড় হুজুরের প্রতি বিশেষ সম্মান রাখতেন। তিনি বলতেন পটিয়ার মুফতি সাহেবের নিকট মুরিদ না হলে গারাংগিয়া বড় হুজুরের নিকট মুরিদ হতেন। তিনি ওয়াজ মাহফিলে আরো বলতেন: ওয়াহাবি হলে আমার মত হও; সুন্নি হলে গারাংগিয়া বড় হুজুরের মত হও। উল্লেখ্য ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে ধর্মীয় জগতে হিংসা বিদ্বেষ লেগেই ছিল। যদিওবা বর্তমান কালে ব্যতিক্রম। অর্থাৎ দেশে দ্রুততার সাথে আহলে হাদীস তথা সালাফীগণের সংখ্যা বাড়ছে। সেসময় দেওবন্দ মতাদর্শীগণ সুন্নি আকিদাকে শিরক বিদআতী বলে মন্দ বলত। অপরদিকে সুন্নি মতাদর্শীরা দেওবন্দ মতাদর্শীকে ওয়াহাবি বলে মন্দ বলত।
আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় দেওবন্দী মতাদর্শ আর ওয়াহাবি মতাদর্শ এক নয়। হয়ত হৃদ্যতা থাকতে পারে। ভারতের উত্তর প্রদেশে দেওবন্দ বিখ্যাত নাম। তথায় বিশ্বখ্যাত দেওবন্দ মাদরাসা ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখানকার ধর্মীয় মতাদর্শকে বিশ্বব্যাপী দেওবন্দ মতাদর্শ বলা হয়। অপরদিকে ওয়াহাবি হল সৌদি আরবের মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের মতাদর্শ থেকে ওয়াহাবি আকিদা। তারা তাদের ইমাম দামেস্কের ইবনে তাইমিয়ার মতাদর্শকে অনুসরণ অনুকরণ করেন। যা একালে আহলে হাদীস তথা সালাফী মতাদর্শ।
গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার ৪৩২ পৃষ্ঠার জীবনী গ্রন্থে ওয়াজেদিয়া মাদরাসার মাওলানা আতিকুল্লাহ খান, বায়তুশ শরফের বাহরুল উলুম খ্যাত মাওলানা কুতুবউদ্দিন (রহ.); জামাতে ইসলামীর মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরী; ফটিকছড়ি নানুপুরের মাওলানা জমিরুদ্দিন; লোহাগাড়ার মাওলানা সারওয়ার কামাল আজিজী; কক্সবাজারের মাওলানা মোজাহের আহমদসহ এতদ্বঅঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের বাঘা বাঘা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণ গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুরের প্রতি সম্মান রেখে যান। যা গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
মাওলানা জালাল উদ্দিন আল কাদেরী ছিলেন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ। তিনি জামিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসার দীর্ঘদিনের অধ্যক্ষ ও জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদের খতিব। তিনিও গারাংগিয়া বড় হুজুরের সভাপতিত্বে অনেক ধর্মীয় মাহফিলে ওয়ায়েজ ছিলেন।
প্রায় শত বছর বয়স প্রাপ্ত হয়ে মাত্র ৩ বছর আগে ইন্তেকাল করেন আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী। তিনি ১৯৫০/৬০ এর দশকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম কক্সবাজার জেলায় বড় বড় মাহফিলে প্রখ্যাত ওয়ায়েজ থাকতেন। এসব মাহফিলের অনেকগুলোতে সভাপতি থাকতেন গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা।
হালিশহরের শাহজাদা সাবের আহমদ ও মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল, চুনতীর মাওলানা হাবিব আহমদ সহ বিভিন্ন মতাদর্শের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণ ২০০৩ সালে প্রকাশিত তাঁর জীবনি গ্রন্থে মতামত দিতে কার্পণ্য করেননি। আমার রচিত ৪৩২ পৃষ্টাব্যাপী উক্ত গ্রন্থে এই প্রবন্ধের নানা তথ্য সন্নিবেশিত আছে। গ্রন্থটি রচনা করতে একটানা দীর্ঘ বছরখানেক সময় দিয়েছিলাম তথ্য তালাশের কারণে।
গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা ইন্তেকাল করেছেন আজ থেকে ৪৬ বছর আগে। ভারতবর্ষে সকল মতাদর্শের কাছে শ্রদ্ধাভাজন থেকে শরীয়ত ও তরিকতের বিশাল খেদমত করে গেছেন। তিনি নিজ হস্তে বাড়ির নিকট ১৯২০ সালে গারাংগিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদরাসার তিনি ছিলেন প্রধান। রাত দিন খেদমতে ছিলেন। মাদরাসা প্রধানের দায়িত্ব পালন করে সামান্য যে সম্মানি পেতেন তা দিয়ে তাঁর সংসার চলত। তিনি ১৯২১ সালে আজমগড়ি হযরতের নিকট তরিকতে দাখিল হন। ১৯৪৪ সালে খেলাফত লাভ করেন। ১৯৬০ এর দশকে ছাত্র জীবনে আমারও তাঁর নিকট মুরিদ হবার সৌভাগ্য হয়।
আমি নিজেও একাধিক স্থানে দেখেছি কত প্রতিকূল পরিবেশে হযরত বড় হুজুর কেবলা মানুষের বাড়িতে অবস্থান করেছেন। জীবনের বড় অংশ তরিকতের জন্য নিজেকে নিজে বিলিয়ে দেন।
গারাংগিয়াতে তাঁর বড় ধরনের তেমন কোন বাড়ী ঘর ছিল না। কাছারী ঘরটা ছিল মাটির দেয়াল উপরে ছনের ছাউনি। এখনে দু’টি কাঠের চেয়ার, দু’টি কাঠের হেলানী টুল, একটি চৌকি মাত্র। হুজুরের কাছে মোলাকাত করতে আসলে তিনি চেষ্টা করতেন তাঁর তাওফিক মত ন্যূনতম কিছু দিয়ে হলেও মেহমানদারী করতে।
তরিকত জীবনে তাঁর ত্যাগ তিতিক্ষা কষ্টের ফসল হাজার হাজার প্রখ্যাত আলেম ছাত্র তাঁর মুরিদ। হাজার হাজার অফিসার, আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ তাঁর মুরিদ।
১৯৫০–১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত তিনি যেখানে যেতেন মানুষের ঢল নামত দোয়া প্রার্থী হতে। বিভিন্ন মতাবলম্বীর বড় বড় আলেমেরা তার নিকট যেতেন দোয়া নিতে। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত কঠোর সুন্নি মতাদর্শী। কিন্তু সকল আকিদা মতাদর্শের সহাবস্থানে বিশ্বাস করতেন। কাউকে মন্দ বলাকে ঘৃণা করতেন।
আমার এ মহান পীর ছাহেব ১৯৭৭ সালে ২১ অক্টোবর শুক্রবার সকালে গারাংগিয়া নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। মোবাইল ত নয়ই ল্যান্ড টেলিফোনও সোনার হরিণ তখন। কিন্তু আছরের সময় জানাযায় গারাংগিয়া মাদ্রাসা ময়দান, রাস্তা, মানুষের বাড়ী ঘরের উঠান, ডলু নদীর চর কয়েক লাখ লোকে লোকারণ্য ছিল।
আমার জীবনের শেষ বয়সে একালের তরিকতের পরিবেশ দেখে মন ব্যথিত। চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাজার পীর। দেশে আজ হাজার হাজার পীর। কিন্তু দুনিয়াকে পদদলিত করে সম্পূর্ণ আল্লাহর ওয়াস্তে তরিকতের খেদমত করতেছেন এ রকম পীর শতকরা কয়জন পাওয়া যাবে! নিজে দুনিয়া চাই না তরিকতের খেদমতে আছেন অনেক অনেক কিছু বলেন। কথার সাথে বাস্তবতা কতটুকু মিল তা নিয়েও ভাবি। মনে হয় তরিকত পীর এসব দুনিয়া ভোগের অবলম্বন।
আহলে হাদীস তথা সালাফী মতাবলম্বীর যেহারে প্রচার চলতেছে তরিকত নয়ই আগামী ৮/১০ বছরের মধ্যে মাজহাব কতটুকু টিকে থাকবে নিজে নিজে ভাবি। একালে তরিকতে লোকের সংখ্যা বড় কথা নয়, ভাল মানুষ কয়জন তরিকতে যাচ্ছে তা নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার।
আশা করব সকল মতাদর্শের শ্রদ্ধাভাজন গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার তরিকতের খেদমত একালে তরিকতে যারা আছেন তারা নিরিবিলি বসে ভাবতে বিনীত অনুরোধ রাখলাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলাম লেখক