সুনীল গঙ্গোপধ্যায় এর ‘শিশু’ কবিতাটিতে রয়েছে ‘তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে/ সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি !/তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো / শিশু রক্তপানে তার গ্লানি নেই ?/ সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে! /যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়/ আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই’’।
এতো সাহিত্যিকের ভাষা, সত্যিকারের মানুষের ভাষা, মানবিকতার কথা, কিন্তু যারা মানুষরূপী অমানুষ তাদের জন্য এ কয়টি লাইন বড় বেমানান, প্রতিশোধে মত্ত ঈর্ষাকাতর বাঙালি, যারা অন্যের পদলেহনে ক্ষমতায় যায়, বা ক্ষমতায় বসে তাদের কাছে সভ্য জগতের সভ্য নীতি বড় বেমানান, তাদের কাছে তাদের স্বার্থটাই বড়, প্রতিশোধই মোক্ষম হাতিয়ার, যার বলী হলেন বঙ্গবন্ধু ও পরিবার সহ ১৮ জন নিষ্পাপ মানুষ। কিন্তু ছোট্ট রাসেল কে হত্যা করা এটা কোন ধরনের প্রতিশোধ! এই প্রতিশোধমূলক কাজ বাঙালি জাতিকে শুধু কলঙ্কিত করেনি, করেছে ঘৃণিত। সাধারণত বলা হয়ে থাকে, শিশুরা ফুলের মতো, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। মানবিকতার দণ্ডে শিশু হত্যা একটা ধিক্কারজনক কাজ।
আমরা যখন পত্র পত্রিকায় বা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক বইগুলোতে, বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখনিতে এবং নানা সময়ের বক্তব্যের বয়ানে শুনি, শেখ রাসেলের মিষ্টি কাহিনীগুলি, তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখে জল চলে আসে, সাথে সাথে নরপিশাচরূপী উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তা বা তাদের নির্দেশদাতাদের প্রতি চোখ থেকে আগুনও বের হয়। আগুন ও জলের পারস্পরিক ক্রিয়ায় জল জয়ী হয়, মন ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে। এ বেদনা বিধুর কাহিনী মনে পড়ার সাথে সাথে আহত পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো ব্যথিত হয়ে পড়ি। আহা ! কী এমন দোষ ছিল এ ছোট্ট শিশুটার ! যখন বলছিল -“আমি মা’র কাছে যাবো’’, তখন বলা হলো, “আয় মা’র কাছে চল’’ বলে খপাৎ করে হাতটা ধরে একে একে বড় ভাই শেখ কামাল, ছোট ভাই শেখ জামাল, দুই ভাবি, চাচা, বঙ্গবন্ধু, এবং মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সহ আরোও অনেক লাশ ডিঙিয়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে জীবন প্রদীপ শেষ করে দিল,এ কেমন বীভৎসতা! এবং চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘অল আর ফিনিশড’, এ কেমন নিষ্ঠুরতা! ভাবতে আমরা নির্বাক হয়ে পড়ি যে, এটাই বাস্তবতা, এটাই সত্য।
ছোট্ট শিশু রাসেল ছিল একটা ফুটফুটে ১০ বছরের আবেগমাখা মুখের মিষ্টি ছেলে। সে কবুতর ভালোবাসতো বলে কবুতর পুষতো, টমি নামের একটা কুকুরও পুষতো, নিজের খাবার অনেক সময় টমিকে দিয়ে দিত, তার খুব প্রিয় একটা সাইকেল ছিল। সাইকেল নিয়ে বঙ্গমাতার দৃষ্টির ভিতর সে ঘুরে বেড়াত। যতক্ষণ সাইকেল নিয়ে ঘুরতো ততক্ষণ বঙ্গমাতা উদ্গ্রীব হয়ে তাকে চোখে চোখে রাখতো, যাতে পাছে শেখ রসেলের কোনও বিপদ না হয়।
বিখ্যাত সাংবাদিক এ,বি,এম, মুছার স্মৃতিকথামূলক লেখনীতে শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, “ক’দিন বিকেল পাঁচটার দিকে শা করে ৩১ নম্বরের অপ্রশস্ত রাস্তা থেকে ৩২ নম্বরে ঢুকেই আমার সামনে প্রপাত ধরনীতল। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি। অতঃপর সাইকেলে উঠে লেকপাড়ে উধাও হলো শৈশবের শেষ প্রান্তের ছোট্ট ছেলেটি। বিকেলে এমনি করে চক্কর মারতো। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বরের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পূর্বপ্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত সাইকেল আরোহীর দৌড়ানোর সীমানা। এদিকে ৩২ নম্বরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্নেহময়ী মা, সজাগ দৃষ্টি রাখতেন দুষ্টু ছেলেটির সাইকেল পরিক্রমা যেন সীমাবদ্ধ থাকে।”
বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হিসাবে’ ছোট্ট রাসেল’ পরিবারের সব সদস্যদের কাছে একটা আলাদা মাত্রার স্নেহের মধ্যমণি হয়েই থাকত। তার প্রমাণ মিলে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারের রোজ নামচা’য়। শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ’৮ ফেব্রুয়ারী দুই বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো কী উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মা’র বাড়ি তুমি যাও, আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায় ! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দু;খ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।”
আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’বইয়ের ২১ পৃ; শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি পনের দিন পর আমরা কারাগারে দেখা করতে যেতাম, রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চায়তো না। খুবই কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাবো, বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকতো’।এসব লেখনী থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু সহ পরিবারের কাছে শেখ রাসেল একটি আদরনীয় গোলাপ ফুলের মতো বেড়ে উঠছিল, যে ফুল একদিন সফল ও সার্থক জীবন নিয়ে আলোর ঝর্ণাধারা হয়ে ছড়িয়ে পড়বে বলে।
শেখ রাসেল চার বছর বয়সে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ঐ স্কুলে সকলের প্রিয় হয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করেছিল। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর যেদিন রাসেলের জন্ম হলো সেদিন বঙ্গবন্ধু বাসায় ছিলেন না, ছিলেন এই চট্টগ্রামে, কী কাকতালীয়! তার জন্মের সাথে চট্টগ্রামও সংযুক্ত হয়েছিল, কারণ ফোন করে চট্টগ্রামে অবস্থান করা বঙ্গবন্ধুকে যখন রাসেলের জন্ম সংবাদ দিয়েছিল তখন চট্টগ্রামের আকাশ, বাতাশ, পাহাড়, নদনদী ও সর্বস্তরের মানুষও হয়তো তাকে স্বাগত জানিয়ে ছিল, বা জানানোর সুযোগ পেয়েছিল, সাথে সাথে তার জন্মের সঙ্গে চট্টগ্রামও ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
ঢাকায় এসে সাহিত্য প্রিয় বঙ্গবন্ধু তার ছোট ছেলের নাম রাখলেন পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেল এর নামে এর সঙ্গে মিলিয়ে ‘শেখ রাসেল’। আসলে ঐ সময়ের ঠিক দু,বছর আগে ১৯৬২ সালে কিউবাকে নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ, কেনেডি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রশ্চেভের মধ্যে স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছিল, যা ভয়ঙ্কর পথে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। সম্ভাব্য বিধ্বংসী স্নায়ুযুদ্ধ থামাতে তিনি সোচ্চার এবং প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠছিলেন। বিশ্বজনমত বার্ট্রান্ড রাসেলের পক্ষে সাঁই দিয়েছিলেন এবং কেনেডি ও ক্রুশ্চেভ যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে সরে এসে ছিলেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির নায়ক সাহিত্যিক বঙ্গবন্ধুর মনে বার্ট্রান্ড রাসেলের নামটি শ্রদ্ধার সাথে অন্তরে প্রোথিত হয়েছিল, তাই তিনি তার প্রিয় ছোট্ট উত্তরসূরীকে ঐ নামটি দিয়ে হয়তো কোনো আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছিলেন, তাই তো পরিবারের নতুন আসা শিশুটির নাম রাখলেন ‘শেখ রাসেল’।
শেখ রাসেল একটি স্বপ্নের নাম, ভালোবাসার নাম, এক আদুরে দুরন্ত শিশুর নাম, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরীর নাম, হয়তো বা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে যাওয়ারও নাম হতে পারতো।–না তার কিছুই হলো না। অকালে শিশু বয়সে হারিয়ে গেল স্বপ্ন, হারিয়ে গেল ভালোবাসা। মিষ্টি দুরন্তপনার শিশুটি ঘাতকের গুলিতে উড়ন্ত হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। নিষ্ঠুর বিধাতা মা–বাবার সাথে তাকেও নিয়ে গেলেন, কিন্তু কেন? ঐ যে বললাম বঙ্গবন্ধু যোগ্য উত্তরসূরী, এটাই হলো কাল। ঈর্ষাকাতর, নরপিশাচ বাঙালি, উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তারা ঐএকটি মাত্র দোষ খুঁজে বের করেছে যে, সে মুজিবের সন্তান তাই তাকে এই দশ বছর বয়সে ফুলের মতো, স্বপ্নের মতো, পাখির মতো, নদীর ঢেউ এর মতো, সবুজে সবুজ দূর্বাঘাসের মতো, বাংলার আদুরে মায়াময় শিশু হয়ে থাকতে দিল না। এই বাংলার আকাশ, বাতাস, নদী, সমুদ্র, জোনাকী পোকারা এখন জিজ্ঞেস করে জানতে চায়, কী দোষ ছিল তার? কারো মুখে কোনো কথা সরে না। এই একটি মাত্র প্রশ্নে সবে হতবাক, স্তব্ধ, নির্বাক। একটি বাক্য মনে পড়ে যায়, যদি বাঙালির সংজ্ঞায়নে বাঙালি হই, তবে এর উত্তর হতে পারে, ‘আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ।