সচেতনতাই এনেসথেসিয়ার বিপদের ঝুঁকি কমাতে পারে

১৭৭ তম বিশ্ব এনেসথেসিয়া দিবস আজ

ডা. কল্যাণ বড়ুয়া | সোমবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

এনেসথেসিয়া অপারেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিটি অপারেশনে বিভিন্ন ধরনের এনেসথেসিয়ার প্রয়োজন হয় এবং একমাত্র এনেসথেটিস্টগন এনেসথেসিয়ার এ গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়াও এনেসথেটিস্টগন আই.সি ইউ, এইচ.ডি.ইউ, ক্রিটিক্যাল কেয়ার এবং পেলিয়েটিভ কেয়ারের মতো বিষয়েও দায়িত্ব পালন করেন।

এনেসথেসিয়ার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অবেদন বা অচেতন। সহজ কথায় বলা যায়, ব্যথাবিহীন অপারেশন। আধুনিক এনেসথেসিয়ার জনক স্যার ডব্লিও. টি. জি মর্টন। ১৮৮৬ ইং সালের ১৬ অক্টোবর এই আমেরিকান ডেনটিস্ট রোগীকে ‘ইথার’ এনেসথেসিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে দিনটি শুভ সূচনা করেন।

দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এনেসথেসিয়া এখন অনেক আধুনিক। এর সাথে উন্নত মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিরাপদ এনেসথেসিয়া এখন হাতের নাগালে। আমাদের দেশে আজকাল ওপেন হার্ট সার্জারী, এনজিওপ্লাস্টি, লিভার ও কিডনি ট্রান্সপেলেন্ট সার্জারিসহ আরো বড় ধরনের সার্জারি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হচ্ছে। এসব নিঃসন্দেহে উন্নত ও নিরাপদ এনেসথেসিয়ের অবদান।

এনেসথেসিয়ার প্রকারভেদে রোগের প্রয়োজনে এবং রোগীর অন্যান্য শারীরিক সমস্যা জনিত কারণে এনেসথেসিয়ার বিপদের ঝুঁকিও বাড়ে। তাই এনেসথেসিয়ার পূর্বে অপারেশন জনিত রোগীর শারীরিক পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট ইনভেস্টিগেশান এবং অপারেশনের আগে রোগীর অন্যান্য রোগের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে বিপদের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যে সকল রোগ এনেসথেসিয়ার জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, তা হলো:

১। ফুসফুস জনিত সমস্যা: শ্বাস প্রশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ফুসফুস। ফুসফুসের কার্যকারিতা ঠিক না থাকলে এনেসথেসিয়ার সমস্যা হতে পারে। এ্যাজমা, ব্রনকাইটিস, এমফাইসিমা, ফুসফুসে পানি বা বাতাস জমা, এছাড়াও কোনো প্রদাহ থাকলে জেনারেল এনেসথেসিয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই এনেসথেসিয়ার পূর্বে রোগীর শ্বাস প্রশ্বাসের কার্যক্রম ঠিক আছে কিনা, তা নির্ধারিত এনেসথেটিস্ট দিয়ে চেক আপ করিয়ে নেয়া দরকার। ফুসফুসের কার্যক্রম ঠিক হলে পর অপারেশনে যাওয়া শ্রেয়।

২। হৃদরোগজনিত সমস্যা: হার্ট এবং ফুসফুস আমাদের জীবন ধারনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ। রোগীর উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের ইসকেমিয়া বা অক্সিজেন স্বল্পতা, ইনফারকশান, ধননীতে ব্লক থাকা, হার্টে পানি আসা, হৃদরোগ জনিত কারণে ফুসফুসে পানি, হার্ট ফেইলিউর এবং হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া। এসব ক্ষেত্রে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। হার্টের কার্যক্ষমতার উন্নতি হলে পরবর্তীতে অপারেশনে এনেসথেসিয়ার বিপদের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে।

৩। কিডনি জনিত সমস্যা: কিডনি শরীরের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ, যা শরীরের দুষিত পদার্থগুলো নিঃসরন করে। কিডনি জনিতরোগ যেমন- নেফ্রাইটিস, নেফ্রোটিক সিনড্রম এবং একুউড ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, কিডনিফেইলিউর যাদের আছে, তাদেরকে এনেসথেসিয়া দেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ বটে।

৪। লিভারজনিত সমস্যা: লিভার হচ্ছে মানুষের এমন একটি অঙ্গ, যা গ্রহণকৃত খাদ্যদ্রব্যকে বিপাকে সাহায্য করে। লিভার জনিতরোগ যেমন- হেপাটাইটিস, জনডিস, সিরোসিস ও লিভার ফেইলিউর ইত্যাদি। এসব রোগ প্রতিকার করার পরে এনেসথেসিয়া দেওয়া উত্তম।

৫। যাদের ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অপারেশনে এনেসথেসিয়ায় বিপদের ঝুঁকি বাড়ায় ও অপারেশান পরবর্তী ক্ষতস্থান শুকাতে বিলম্ব হয়।

৬। যাদের অনিয়ন্ত্রিত ইল্কট্রোলাইট রয়েছে, তাদেরও এটিকে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আনতে হবে, নয়তো এনেসথেসিয়ার রিকভারী হতে বিলম্ব হতে পারে।

উল্লেখিত রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে এনেসথেসিয়া প্রদান করলে বিপদের ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে।

প্রি-এনোসথেটিক চেক আপ:

এটি এনেসথেসিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এটি করা হলে রোগীর এনেসথেসিয়ার জটিলতা অনেক কমে আসে।

অপারেশনের ২৪ ঘণ্টা আগে রুটিন সার্জারীর রোগীদের শারীরিক পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় ইনভেস্টিগেশান দেখে রোগীকে এনেসথেসিয়ার ফিটনেস দেওয়া হয়।

সুবিধা সমূহ:

১। রোগীর শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়।

২। রোগীর কি ধরনের এনেসথেসিয়ার প্রয়োজন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।

৩। রোগীর এনেসথেসিয়া বা অপারেশন সংক্রান্ত জটিলতা সম্পর্কে রোগী এবং রোগীর আত্নীয় স্বজনকে ধারনা দেয়া যায়।

৫। সর্বোপরি রোগীকে আশ্বস্ত করা যায় যে, অপারেশন বা এনেসথেসিয়ায় ভয়ের কোনো কারণ নেই, অপারেশন শেষে আপনি আবার জেগে উঠবেন। এতে রোগীর অপারেশন ও এনেসথেসিয়া ভীতি বহুলাংশে কমে যায় এবং অপারেশনের জটিলতাও কমে আসে।

রোগীর অপারেশন কালীন সময়ে এনেসথেটিস্টগণ রোগীর পাশে বসে রোগীর নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ এনেসথেসিয়া নিশ্চিত করা যায়।

২০২২ ইং সালের বিশ্ব এনেসথেসিয়া দিবসের শ্লোগান ছিলো, Medication Safety . অর্থাৎ ওষুধ প্রয়োগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাড়াহুড়ো করা, অমনযোগিতা ও অতি ব্যস্ততার কারণে ভুল ওষুধ প্রয়োগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করাই এ শ্লোগানের মূল লক্ষ্য ছিলো।

২০২৩ ইং সালের WFSA (World Federation of Anaesthesiologists) Gi annual theme হচ্ছে-এনেসথেসিয়া এবং ক্যান্সার কেয়ার।

সবশেষে বলা যায়, আমাদের দেশে সার্জনদের ফি এর পাশাপাশি এনেসথেটিস্টদের ফি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এ ধরনের বৈষম্যের কারণে এনেসথেটিস্টদের মনে সৃষ্ট হতাশাই ডাক্তারদের এনেসথেটিস্ট হিসাবে ক্যারিয়ার করতে না আসার মূল কারণ এবং ফলে দেশে আজো এনেসথেসিওলজিস্টদের অপ্রতুলতা রয়ে গেছে।

দশ বছর আগে এনেসথেসিয়ার ১৬৭ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে ‘অপারেশনের রোগীর জন্য জরুরি তথ্য’ সম্বলিত একটি পোস্টার সোসাইটি অব এনেস্থেসিওলজিস্ট এন্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, চট্টগ্রাম শাখা প্রচার করে। এটি অপারেশন সংক্রান্ত রোগীদের জ্ঞাতার্থে আবারো প্রচার করা হলো, যা রুগি এবং রুগির আপনজনদের সচেতন করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে আশা রাখি।

লেখক: অধ্যাপক: সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণতন্ত্রের পূর্বশর্ত মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ
পরবর্তী নিবন্ধসাবেক মেয়র মনজুর আলমের মাসব্যাপী মিলাদ ও দোয়া মাহফিল সম্পন্ন