প্রাতঃকালীন মানচিত্রবিহার
বাবা, বাবা
ফিস ফিস শব্দের অভ্রর এ ডাকের সাথে গালের উপর ওর ছোট্ট হাতের কোমল স্পর্শে পিট পিট করে চোখ খুলে বুঝতে পারলাম এতক্ষণ ঘুমেই ছিলাম। অন্ধকার করে ঠাহর করার জো নেই, বাজে ক’টা এখন। অতি সন্তর্পণে গা সাথে গা ঘেষে, বিছানার মাথার দিকে উঠে বালিশ খাড়া করে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে আধবসা ভঙ্গিতে মাথা তুলে, আমাদের দুজনের মাঝ থেকে বেরিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়া অভ্রকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
কী বাবা, কী হয়েছে?
‘এই যে দেখো না, একটা পেট শপ খুঁজে পেয়েছি।’ বলতে বলতে ওর হাতযন্ত্রটা ধরলো ও চোখের সামনে
ওহ তাই নাকি? দেখি দেখি বলতে বলতে বিছানার পাশ টেবিলের বাতিটি জ্বালিয়ে হাতযন্ত্রের পর্দায় তাকাতেই চোখে পড়লো, অনেক চতুষ্কোণ ব্লক আর সেগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়া মূলসড়ক আর পাশ রাস্তায় আকীর্ণ বেইজিং শহরের একাংশের ম্যাপ। আশার কথা, লেখা যা দেখতে পাচ্ছি ছোঁয়াফোনের পর্দায় সবই ইংরেজি। কিন্তু ঐ যে বলেছিলাম ম্যাপকানা আমি। অতএব যতোই ওতে ইংরেজি লেখা দেখি না কেন, ওটা দেখার খুব একটা আগ্রহ পেলাম না। কিন্তু ম্যাপের ব্যাপারে আমার এই অনাগ্রহটিকে যাতে অভ্র যাতে ভুল না বোঝে তা নিশ্চিত করার জন্য গভীর আগ্রহে বললাম
কোথায় ওটা, দেখাও তো বাবা? সাথে সাথেই ডান হাতের তর্জনীতে ম্যাপের সেই জায়গাটি ও দেখাতেই দেখলাম, হ্যাঁ ছোট ছোট ইংরেজি হরফে পর্দায় চায়নিজ ঝুং ঝাং পুং পাং কি একটা নামের শেষে লেখা আছে পেটশপ।
দেখে বললাম, ভেরি গুড। কিন্তু এটা যে কোথায় তা তো বুঝতে পারছি না
‘এই যে দেখো এখানে লেখা আছে, এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে আছে ওটা। ঐটার কাছে একটা মেট্রোরেল স্টেশনও আছে।’ অভ্রর জবাবে বুঝলাম, নাহ বেশ আটঘাট বেঁধেই পুত্র আমার নেমেছিল তার এই প্রাতঃকালীন মানচিত্রবিহারে। একই সাথে মনে হল, আচ্ছা এখানকার অনলাইনের সুপার হাইওয়েতে সার্বক্ষণিক যে সাইবার কাঁটাতারের বেড়া আছে, তা ডিঙ্গিয়ে গুগল মামুর এই ম্যাপ বের করলো কীভাবে অভ্র? ব্যাপারটা খোলাসা করার জন্য ওকে জিজ্ঞেস করতেই নির্বিকার উত্তর পেলাম
আলী বাবার সেই ‘সিসিম ফাঁক’ মন্ত্রের মতো ডিজিটাল দুনিয়ার বন্ধ দরজা খোলার জন্য ভি পি এন নামের যে অ্যাপ আছে সেটার মাধ্যমেই করেছে ও এই অসাধ্য সাধন।
তাইতো, তাইতো। আমারও তো ফোনে আছে সেই সিসিম ফাঁক অ্যাপ। কিন্তু আমার ফোন যেহেতু অফিসিয়াল ফোন, তাই বারবার তা দিয়ে এখানকার সাইবার কাঁটাতার অতিক্রম করার ইচ্ছা জোর করে দমন করলেও পুত্ররা তো এরই মধ্যে প্রায়শই ডিঙ্গিয়েছিল তা, যদিও খুব একটা লাভ হয়নি। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তা মনে ছিল না।
ঠিক আছে, নাস্তা শেষে প্রথমেই যাবো তোমার ঐ পেটশপে। তবে আগে সকাল হোক। এবার শুয়ে পড়ো তো।
‘সকাল তো হয়ে গেছে বাবা? ইটস এইট টেন নাউ!’
আরে তাইতো! হাতযন্ত্রের পর্দায় অভ্রর তর্জনীর মাথায় ছোট্ট করে লেখা সময় নির্দেশক অংকগুলো দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল যে সকাল আসলেই হয়েছে। জানালায় ভারী পর্দা ভালো করে টেনে রাখায় রুমের রুমে এখনো বিরাজমান রাতের অন্ধকার। কিন্তু আমার ফোনের এলার্ম বাজলো না কেন?
এ ভেবে পাশটেবিলে রাতভর চার্জ হতে থাকা ফোনটি হাতে নিয়ে পরখ করতেই বুঝলাম, আজ যেহেতু তড়িঘড়ি করে ভোরে উঠার তাড়া ছিল না, সে জন্য কোনো এলার্ম দেইনি। তদুপরি নাস্তা যেহেতু করবো ঠিক করেছিলাম হোটেলের রেস্টুরেন্টেই, ফলে নাস্তা সাজানো নিয়ে লাজুরও নেই কোনো তাড়া। ফলে লাজুও হয়তো দেয়নি এলার্ম তার ফোনে। দিলেও দিয়েছে তা আরো পরের কোনো সময়ে। একটু দেরিতে ঘুম ভাঙলেও তো আজ অসুবিধা নেই কোনো। শপিংডে বলে ঘোষিত আজকের দিনে শপিং করার জন্যেও যে দূরে কোথাও যেতে হবে, তাও নয়। গতকাল সন্ধ্যাতেই সে মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল।
এখন ধারণা করছি এই হিমে এখানকার দোকানপাঠ, বিশেষত শপিংমলগুলো হয়তো ১০ টা ১১ টার আগে খুলবে না। সে হিসাবে আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে কাটালেও আমাদের অসুবিধা নেই। তবে ঢাকায় রেখে আসা প্রিয় কুকুরের বাচ্চা প্লুটোর জন্য খেলনা কেনার যে পরিকল্পনা আছে অভ্রর মনে, বলেছিল যা সে গোপনে আমাকে, বেইজিং আসার পথে কুনমিং এয়ারপোর্টে, আজ সকালে যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য মুখিয়ে আছে ও। এ চিন্তা মাথায় নিয়েই সে নিশ্চিত ঘুমিয়েছিল গতরাতে। তাতে ঘুম কেমন যে হয়েছে ওর জানি না। তবে ঐ উত্তেজনায় সে যে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে, প্রথমেই ছোঁয়াযন্ত্রে খুঁজে বের করেছে এই অজানা শহরের কোথায় আছে পেট শপ, তা তো পরিষ্কার। অতএব এখন ওকে আশ্বস্ত করা দরকার।
এ কথা ভাবতে ভাবতেই মনে হল, আচ্ছা এই হোটেলের ব্রেকফাস্ট টাইম যদি দশটা পর্যন্ত হয়, তবে তো এখনই বিছানা ছাড়া দরকার অন্তত আমার। কারণ সবার প্রাতক্রিয়াদি সম্পন্ন করে নাস্তা করার জন্য রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেও ঘণ্টা খানেকের উপরে লেগে যাবে। আক্রা দামে পাঁচতারকা রেস্টুরেন্টে শেষ মুহূর্তে ঢুকে তড়িঘড়ি করে নাস্তা করতে হলে তাতে তৃপ্তি যেমন হবে না, তেমনি তা তো পোষাবেও না!
ধীরে সুস্থে বিছানা ছেড়ে তাই, সপুত্রক সোফায় গিয়ে বসে ওকে জানালাম যে বেইজিং এর এই হিমে তার সেই পেটশপ সহ বাকি দোকানপাঠও সাড়ে দশটা এগারোটার আগে খুলবে না। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত থাকতে পারে যে নাস্তা করার পর প্রথমেই যা করবো অন্তত আমি ওকে নিয়ে, তা হল এখান থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সেই পেটশপ খুঁজে বের করবো।
একথা শুনে নিশ্চিন্ত এক হাসি দিয়ে ও জিজ্ঞেস করলো, যাবে কি না ও ঐ রুমে ভাইয়ার কাছে? উত্তরে বললাম যেতে পারো, তবে যাওয়ার আগে দাঁত মেজে মুখ হাত ধুয়ে যাও।
কিন্তু নাহ, যাহা বলিলাম তাহার পুরোটা তাহার কর্ণে পশিলেও মর্মে যে পশিল না, বুঝিতে পারিলাম তা। কারন এরই মধ্যে এক দৌড়ে সে দ্বার খুলিয়া কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। নাহ, আর সোফায় উপবেশিত হইয়া থাকিয়া কালক্ষেপণ করিবার কোনই কারণ নাহি। এমত ভাবিয়া প্রাতঃকালীন অবশ্য করণীয় কর্তব্য পালন করিতে প্রক্ষালন গৃহের দিকে পা বাড়াইতেই, কক্ষের আপাত নিঃসীম নীরবতা ভঙ্গ করতঃ বিছানার অপর পার্শ্ব হইতে লাজুর স্পর্শফোন কর্ণবিদীর্ণ করিল। সাথে সাথেই ‘কী ব্যাপার, তোমরা কখন উঠেছ? অভ্র কোথায়?’ ফোনের এলার্ম থামিয়ে ঘুমভাঙ্গা জড়ানো কণ্ঠে লাজু জিজ্ঞেস করতেই বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে গলা উঁচিয়ে উত্তর দিয়ে ঢুকে পড়লাম বাথরুমে।
মনে পড়ছে, গতরাতে বহুক্ষণ যাবত নানান তরিকায় ঘুমের হাত পা ধরে অনুনয় বিনয় করার পর, কখন যে তিনি এসেছিলেন তা বুঝতে পারছি না। তবে ঘুমটা যে ভালোই হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। এছাড়াও গতদিনের অতি হাঁটাহাঁটির ছাপ যে রয়ে গেছে শরীরে তাও বুঝতে পারছি। পায়ের নানান পেশিতে পেশিতে অনুভূত হওয়া হালকা ব্যথা জানান দিচ্ছে তা। তারপরেও বলতে হয়ে শরীরটা বেশ চনমনেই। বড় কথা হলও যতক্ষণই ঘুমিয়ে থাকি না কেন, বেশ গাঢ় ঘুমই ঘুমিয়েছিলাম। সেই ঘুমে কোনো স্বপ্ন দেখেছিলাম বলে মনে করতে পারছি না।
স্বপ্ন দেখে দেখে আধাঘুম ঘুমানোতে লাভ তো নেই কোনো আসলে। রাতভর ঐরকম আধাঘুম ঘুমালেও শরীরে ক্লান্তি কাটে না। এছাড়া জ্ঞানী লোকেরা তো বলেছেনই, স্বপ্ন দেখলে দেখতে হয় জেগে জেগে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখায় মানব সমাজের কোনোই লাভ হয় না। না এ কথাটা মনে হচ্ছে পুরোপুরি ঠিক না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, তাতে আর কারো কোনো লাভ না হলেও খোয়াবনামা প্রকাশকদের প্রচুর লাভ হয় নিশ্চিত। হয় লাভ খোয়াবনামা বিক্রেতাদেরও। কপাল যদি অতি ভালো হয়, তবে ঐ লাভ থেকে চুইয়ে চুইয়ে অল্পস্বল্প যা পড়ে তা হয়তো কিছুটা খোয়াবনামা লেখকেরও ভাগ্যে জোটে। অবশ্য কথা সেটাও না, আসলে এই অধমের জেগে দেখা স্বপ্নেও মানব জাতির কোনো উপকার হয়নি এ পর্যন্ত। বরং জ্ঞানী লোকদের কথা মেনে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে এতোকাল বিশেষত রাতের বিশাল ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে আজ এই বেইজিং এর সকালে বুঝতে পারলাম যে, ঐ কথা তো জ্ঞানীরা আমার মতো বেহদ্দ বেকুব অকর্মণ্যের জন্যে বলেননি। ওনারা তো বলেছেন তা উদ্ভাবক আর বিপ্লবীদের জন্য। বেহুদাই নিজেকে কেন আমি ওইদলের একজন মনে করলাম?
নাহ, কবিগুরু তো এই জন্যেই বলেছিলেন বহু আগে ‘আমরা সবাই রাজা’। এ কারণেই তো আমিও ভেবেছিলাম, আমারও জেগে জেগে দেখা বা ঘুম নষ্ট করা স্বপ্নে বুঝি মানব জাতির বিরাট উদ্ধার হয়ে যাবে! অথচ আজ পর্যন্ত নিজের ঘুম নষ্ট করা ছাড়া তাতে তো হয়েছে লবডঙ্কাটা! অতএব দোষতো অবশ্যই আমার না। দোষ কিছু হয়ে থাকলে হয়েছে তা ঐ কবি গুরুরই।
এইসব নানান চিন্তা করতে করতে প্রাতঃক্রিয়াদি সম্পন্ন শেষে জামা কাপড় বদলে বাইরে বেরুবার জন্য মোটামুটি তৈরি হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে রুমে পা রাখতেই, ঐ রুমে গিয়ে ওদেরকে তৈরি হবার তাড়া দেবার অলঙ্ঘনীয় হুকুম আসতেই তথাস্তু রওয়ানা করলাম সেই দিকে।
এ রুমের বেল বাজাতেই, দরজা খুলতে খুলতে হেলেন জিজ্ঞাসা করলো
‘নাস্তা করতে যাবো না আমরা দাদা?’
ওর প্রশ্নেই মনে পড়লো সময়ের পরিক্রমায় পেশাগত কারণে অফিস ডে তে আমি নিজে ছোটবেলায় আব্বার কারণে শেখা অভ্যাসবশত ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করলেও, ছুটির দিনগুলোতেই বেশ দেরিতেই বিছানা ছাড়ি। ফলে নাস্তাও করি দেরিতেই। সেক্ষেত্রে হেলেন ছোটবেলায় শেখা সেই অভ্যাসটি এখনো ধরে রেখেছে ঠিক ঠিক। অতএব ওর নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে। কথা হচ্ছে লাজু তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তো যাওয়া যাবে না রেস্টুরেন্টে, কিন্তু মুখ ফুটে ঐ কথা বলতে গেলেও তো পড়ে যাবো ননদ ভাবি বিষয়ক জটিলতায়। ফলে সেদিকে না হেঁটে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম
হ্যাঁ, সে জন্যই তো এলাম তোদের ডাকতে। দীপ্র কি রেডি হয়েছে? দীপ্র, দীপ্র।
‘দীপ্র আর আমি তো রেডি হয়ে আছি অনেকক্ষণ। ওকে নিয়ে যখন বেরুবো তখনি অভ্র এসে হাজির। সেই থেকে দুই ভাই কী যেন করছে আইপ্যাডে। আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।’ হেলেনের কথা শুনতে শুনতে রুমে ঢুকে দেখি দুই ভাই গভীর মনোযোগে আসলেই ব্যস্ত দীপ্রর আইপ্যাডে
কী ব্যাপার, বাবারা? কী করছো তোমরা?
‘অভ্রর ঐ পেটশপের লোকেশনটা বের করতে চাচ্ছি বাবা। কিন্তু এই হোটেলের ওয়াই ফাই একদম ফালতু। অভ্র নাকি খুব ভোরে উঠে অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর ভি পি এন দিয়ে ওর আইপড থেকে গুগল ম্যাপে ঢুকতে পেরেছিল, কিন্তু এখন তো আর আমি পাচ্ছি না তা আইপ্যাডে। চেষ্টা করছি ওটা বের করতে।’
কী দরকার আর? অভ্রর আইপডেই দেখো না।
‘নাহ, ওটার স্ক্রিন তো ছোট। আইপ্যাডে তো আরো বড় করে দেখা যাবে তাই চেষ্টা করছিলাম। আচ্ছা ঠিক আছে। দেখি তো অভ্র তোমার আইপডেই দেখি।’ বলেই অভ্রর আইপড হাতে নিয়ে দীপ্র বলল ‘কী ব্যাপার এখানেও তো আর পাচ্ছি না ওটা। এখন কী হবে?’
‘স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছি আগেই।’ নিশ্চিন্ত কণ্ঠে জানাল তখন অভ্র তা !
লেখক: ভ্রমণ সাহিত্যিক।