বিশ্ব ঐতিহ্য শান্তিনিকেতন

রেজাউল করিম | বুধবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৩ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

কবিগুরুর শান্তিনিকেতন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে সম্প্রতি। শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থানের তালিকায় নিয়ে আসতে ২০১০ সালে উদ্যোগী হয়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সচিব এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগের পরিচালক। তবে সেইসময় স্বীকৃতি মেলেনি।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে অবস্থিত একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র শান্তিনিকেতন। ১৮৬৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তরপশ্চিমাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। ১৯১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৫১ সালে একে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ঘোষণা করে ভারত। ১৮৬৩ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রম, ১৯০১ সালে স্কুল এবং ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হলেও এগুলো আলাদা ও বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল না।

আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী শুরু হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথের মনে এই সমগ্রতার চিন্তা ছিল। ১৯১৬ সালে তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন : ‘পৃথিবীর সঙ্গে ভারতকে সংযুক্ত করার সূত্র হিসেবে শান্তিনিকেতন স্কুলকে গড়ে তুলতে হবে। সেখানে আমাদের পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবতাবাদী গবেষণার জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে’।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘এই প্রসারিত ও পরস্পর গ্রথিত পথে আমাদের নিজেদেরকে উপলব্ধি করতে হবে, নচেৎ আমরা যে শিক্ষা লাভ করব তা হবে ভিক্ষুকের মতো। ভিক্ষা করে কোনো জাতি ধনী হতে পারে না।’

বিশ্বভারতীর ধারণায় সার্বিক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং শ্রীনিকেতনে অর্থনীতিবিদ, কৃষিবিদ, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, ধাত্রী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং গ্রামীণ শিল্প ও শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণও গ্রামীণ সমস্যার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গ্রামবাসীদের সঙ্গে পরীক্ষানিরীক্ষা ও কাজ করতেন। গবেষণা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানের মধ্য দিয়েই শান্তিনিকেতনের কার্যপদ্ধতি গড়ে উঠেছিল। গ্রামের যুব সমপ্রদায়কে আত্মনির্ভরশীলতায় ব্রতী করার জন্য ‘ব্রতী বালক সংগঠন’ নামে একটি স্কাউট আন্দোলনও সংগঠিত হয়েছিল। শিশুদের প্রস্তুত করতে পারলে বয়োজ্যেষ্ঠরাও আকর্ষণ বোধ করবেন।

নতুন এক শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় মানসকে হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করাও ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা। ১৯২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু ছিলেন এর আচার্য, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সরোজিনী নাইডু ছিলেন তাঁর উত্তরসূরি। প্রাথমিক পর্যায়ে বহু বিশিষ্ট ইউরোপীয় পণ্ডিত বিশ্বভারতীর উন্নয়নে অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সিলভা লেভি, স্টেন কনো, তুচ্চি, কলিন্স, ভোগডানভ, আঁদ্রে কারপেলেস, স্টেল্লা ক্রামরিশ, লিওনার্ড এমহার্স্ট গ্রামীণ সমাজকল্যাণ কর্মকাণ্ডের উন্নয়নে সাহায্য করেছিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বিশ্বভারতীতে গ্রন্থাগারিকরূপে যোগদান করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে গণশিক্ষার জন্য একটি বিভাগ এবং ১৯৩৮ সালে শিল্পসদন (চারুকলা ইনস্টিটিউট) সংযোজন করা হয়েছিল।

বিশ্বভারতীর বিভিন্ন অঙ্গ হচ্ছে পাঠভবন (বিদ্যালয়), শিক্ষাভবন (মহাবিদ্যালয়), বিদ্যাভবন (স্নাতকোত্তর ও গবেষণা), কলাভবন (চারুকলা), সঙ্গীতভবন (সঙ্গীত), পল্লী সংগঠন (গ্রামীণ সংগঠন), গ্রন্থন (প্রকাশনা) ইত্যাদি। ১৯৩৭ সালে অধ্যাপক তান ইয়ুনসানের সহযোগিতায় চীনাভবন (চীনভারত পাঠ) সংযোজিত হয়েছিল। হিন্দিভবন ও রবীন্দ্রভবন যোগ করা হয়েছিল যথাক্রমে ১৯৩৯ এবং ১৯৪২ সালে, শেষোক্তটি হচ্ছে রবীন্দ্র গবেষণাকেন্দ্র এবং এতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাণ্ডুলিপি, চিত্রকর্ম, চিঠিপত্র ও গ্রন্থগুলি রক্ষিত আছে।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা ছিল সর্বজনীন। শিশুরা সবসময় মুক্ত পরিবেশ পছন্দ করে। শিক্ষা যাতে নীরস ও যান্ত্রিক না হয়, সেজন্য তিনি ছাত্রদেরকে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করার কথা বলেছিলেন তিনি। খাঁচায় নয়, শিশুরা বেড়ে উঠবে মুক্ত পরিবেশে। শান্তিনিকেতন বাঙালির শান্তির ঠিকানা।

ইউনেস্কোর হেরিটেজের তালিকায় যে নাম উঠতে পারে শান্তিনিকেতনের, তা চলতি বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর পরের দিনই ইঙ্গিত দিয়েছিল কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি এক্সে লিখেছিলেন, ‘‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে সারা দেশের জন্য সুখবর। শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।’’ এই প্রস্তাব দিয়েছিল ইউনেস্কোর উপদেষ্টা সংগঠন ইকোমস। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক এবং দেশের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের হয়ে শান্তিনিকেতনের জন্য দাবিপত্রটি সংরক্ষণ স্থপতি আভা নারায়ণ লাম্বা এবং মনীশ চক্রবর্তী মিলে তৈরি করেছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রেড্ডি জানিয়েছিলেন, বিশ্বভারতী আনুষ্ঠানিক ভাবে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় ঠাঁই পেল কি না, তা সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরবের রিয়াধে একটি সভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হবে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরে সেই ঘোষণা করল ইউনেস্কো।

১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে স্কুল এবং ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর পথ চলা শুরু। ১৯৫১ সালে এই প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। তবে গত কয়েক মাসে এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এর আগে এই রাজ্যের দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেন এবং সুন্দরবন ইউনেস্কোর এই হেরিটেজ তালিকায় উঠে এসেছে। তবে সুন্দরবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং টয়ট্রেনের সঙ্গে নীলগিরি পাহাড় ও শিমলার রেলগাড়িও গৌরবের শরিক। আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে দুর্গাপুজোকেও স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ বার শান্তিনিকেতন। ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকায় তা একক ভাবেই জায়গা করে নিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্যার-ম্যামদের ক্লাস
পরবর্তী নিবন্ধকেউ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালালে দেশের মানুষ প্রতিহত করবে : নওফেল