প্রবাহ

ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রামের অবদান নেই বলা যাবে না

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

চলতি অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ তুরস্কের জাতীয় দিবস। তাও আবার শততম প্রজাতন্ত্র দিবস। এ দিবসকে সামনে রেখে ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রামের অবদান নিয়ে আজকের প্রয়াস। সুলতান ২য় মুহাম্মদ আজ থেকে ৫৭০ বছর পূর্বে ১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল জয় করতে সক্ষম হন। এ জয় কালিন কোন না কোনভাবে চট্টগ্রামের অবদানকে অস্বীকার করা যাবেনা। ইস্তাম্বুলের অবস্থান ইউরোপ এশিয়ার সংযোগস্থলে বসফরাস প্রণালীর দুই তীরে ।

আল্লাহর রসুল (.) ইস্তাম্বুল জয়ের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে গেছেন। ফলে আমিরে মুয়াবিয়ার আমলে ইস্তাম্বুল জয় করতে পর পর দুইবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় মুসলমানগণ এই দুই অভিযানেই ব্যর্থ হয়।

আল্লাহর রসুল (.)’র আমল থেকে দীর্ঘসময় ইস্তাম্বুলকে বলা হত কুসতুনতুনিয়া। পরবর্তীতে রোম সম্রাটের টাইটেল কনস্টান্টিনেটের নামকরণে কনস্টান্টিনোপল হয়। সুলতান ২য় মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল জয় করার পর এর নামকরণ করেন ইস্তাম্বুল।

সম্ভবত ইস্তাম্বুল নামটি একটি গ্রীক শব্দ থেকে উদ্ভব হয়েছে। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পূর্বে অটোমান সাম্রাজ্যের লোকদের কাছে ইসতিনপোলিন নামটি বিস্তার লাভ করে। অপর বর্ণনায় সুলতান ২য় মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল জয়ের পর এর নামকরণ করেন ইসলামবুল। বুল তুর্কি শব্দ হতে পরে তা পরিবর্তিত হয়ে ইস্তাম্বুল হয়।

বন্দরের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্বের কাছে প্রাচীনকাল হতে পরিচিত। যেহেতু দূর যাত্রায় যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল সাগর পথ। আরবীয়গণ ছিলেন ব্যবসায়ী। তারা দূর যাত্রায় সাগর পথ ব্যবহার করতেন। ফলে প্রাচীনকাল থেকে যাতায়াতকালে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার ছিল স্বাভাবিক। মহান সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবেতাবেয়ীগণ চীন তথা বিশ্বের পূর্ব দিকে যাওয়াআসা কালে চট্টগ্রাম বন্দরে যাত্রাবিরতির কথা ইতিহাস সাক্ষী দেয়।

১২০০ সালের দিকে উসমানীয় তুর্কি সালতানাতের যাত্রা শুরু। তাদের সাথে আরবীয়গণের অত্যধিক সখ্যতা, যেহেতু তুরস্কের পূর্ব দিকে আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং পূর্ব দক্ষিণে মুলকে শাম ও মিশর ইত্যাদি অঞ্চল।

তুর্কি সালতানাত বিস্তার লাভ করার সাথে সাথে সাগরপথে নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনী গঠন করবে স্বাভাবিক। কাজেই তাদের শীপইয়ার্ড থাকবে তা নিশ্চিত বলা যায়। মিশর জয়ের পর তুর্কি সুলতানগণ ভূমধ্যসাগরের তীরে আলেকজান্দ্রিয়া (আরবীতে ইসকানদারিয়া) নিজস্ব শীপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন।

তুর্কি সুলতানগণের কাছে সংবাদ পৌঁছে চট্টগ্রাম বন্দরের শীপইয়ার্ডে নির্মিত শীপ গুলো খুবই মজবুত টেকসই, দামেও সস্তা। মোহরা কালুরঘাট এলাকায় সেসময় কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা ছিল। আজও ঐ এলাকায় বহুতল দালান নির্মাণ করতে ৮০/৯০ ফুট বা আরও বেশি গভীরে পাইলিং করতে হয়।

অপরদিকে পূর্ব দিকে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ কি.মি. এর মধ্যে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে দুর্গম পাহাড় পর্বতে নানান গাছের সমাহার। তথা হতে বিশাল বিশাল গাছ কেটে কর্ণফুলী নদীপথে মোহরা নিয়ে আসা সহজসাধ্য। শীপইয়ার্ড এবং সহজে কাঠ পাবার জন্য এরকম প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ বিশ্বে হয়ত হাতেগোনা কয়েক জায়গায় থাকতে পারে।

তুর্কি সুলতানগণ চট্টগ্রাম শীপইয়ার্ডের খবরাখবর জানতে পেরে এখান থেকে শীপ কিনে নিয়ে যেতেন। ফলে তুর্কি সালতানাতের আরবী ও তুর্কিগণ চট্টগ্রাম আসা এবং চট্টগ্রামের লোকজন নতুন শীপ পৌছে দিতে তুরস্কে যাবে অনেকটা স্বাভাবিক বলা যায়। ইস্তাম্বুলে ইউরোপীয় অংশে বসফরাস প্রণালীর তীরের নিকটে সুরক্ষিত অপ্রতিরোধ্য দুর্গের অবস্থান যা গোল্ডেন হরণের পাশে।

প্রতিপক্ষের নৌশক্তি যাতে কয়েক কিলোমিটার ভিতরে গোল্ডেন হরণে প্রবেশ করতে না পারে সে লক্ষ্যে বৃহদাকারে লোহার শিকলসহ একাধিক নৌপ্রতিরক্ষা ব্যুহ করে রাখে।

মাত্র ২১ বছরের যুবক সুলতান ২য় মুহাম্মদ অতি গোপনে ও অতি সাবধানে ইস্তাম্বুল জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন। এই অতি সুরক্ষিত দুর্গ জয় করতে গোল্ডেন হরণে সামরিক নৌযানের সাহায্য অপ্রত্যাশিত। ফলে তিনি রাত্রিকালে কাঠ নির্মিত দুইশত ফুট দৈর্ঘ্যের প্রায় দুইশতের কমবেশি জাহাজকে পাহাড়ের উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাষ্ঠ নির্মিত একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। চাকা ওয়ালা পরিবহন দিয়ে তা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ জাহাজগুলোতে কামান স্থাপন করা হয়। শুধু তাই নয়, এতে আরো অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৯ টন ওজনের বোমব্যাট কামান। ঐ সময় কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত লাখের কাছাকাছি সশস্ত্র তুর্কি সৈন্য এ সুরক্ষিত দুর্গজয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতিরত। কারো মতে এই সংখ্যা ১ লক্ষ ৬০ হাজার, কারো মতে ২ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ। তবে সুলতান ২য় মুহাম্মদ পিছনের দিকে গোল্ডেন হরণ দিয়ে আক্রমণ করাকে খুবই গুরুত্ব দেন। যাতে আক্রমণ অকৃতকার্য না হয়।

চট্ট্রগ্রাম শীপইয়ার্ডে ছোট বড় জাহাজ বানানো এবং শীপইয়ার্ড থেকে কর্ণফুলী নদীতে নামানোর ব্যাপারে চট্টগ্রামবাসীর দক্ষতা স্বাভাবিক।

সুলতান ২য় মুহাম্মদ অনেক দিন আগে থেকে ইস্তাম্বুল জয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কাজেই চট্টগ্রাম থেকে মজবুত টেকসই জাহাজ নিয়ে যাননি, এই জাহাজের সাথে চট্টগ্রামবাসী ছিলনা তা বলা যাবেনা। বরং চট্টগ্রাম থেকে মজবুত টেকসই জাহাজ নিয়ে যাওয়া সাথে চট্টগ্রামবাসী থাকার পক্ষে যৌক্তিকতা বেশি।

চট্টগ্রামের বয়স্কজনের মুখ থেকে একটি বাক্য এখনো হারিয়ে যায়নি, শত শত বছর ব্যাপী চলমান রয়েছে আর তা হল:

ছল্লুকর নৌকা ফ’ারদি ছলে” অর্থাৎ সেলজুকিয় তুর্কি সুলতানগণের নৌকা পাহাড় দিয়েও চলতে পারে। এ বাক্যটি চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে অনেকটা সীমাবদ্ধ বলতে পারি। অর্থাৎ ইস্তাম্বুল জয়ে চট্টগ্রামবাসী থাকার কারণেই দেশে ফিরে এসে এই বাক্য চট্টগ্রামে প্রচার হয়ে গেছে তা বিশ্বাস করে নেয়া স্বাভাবিক।

মায়ানমার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিশাল ভারতবর্ষের মধ্যে চট্টগ্রামের সাথে তুর্কি সালতানাতের আলাদা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক মনে হয় শত শত বছর জাগরুক থাকে।

চট্টগ্রামের মানুষ সচ্ছল, ব্যবসায়ী, উদারপ্রাণ মন খুলে খরচ করে। করেন দান এবং আতিথেয়তা। তুর্কি সুলতানগণ ৪/৫ শত বছর হেজাযে পবিত্র মক্কা পবিত্র মদিনায় খেদমত করে গেছেন। সেই সময় থেকে চট্টগ্রামবাসীর তুর্কি সালতানাতের সুসম্পর্কের তৃতীয় কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়ায় পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা। চট্টগ্রামের চান্দ মিয়া সওদাগর, হোটেল মিসকার মালিক ইসলাম খান, আমিরুল হজ খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী তুর্কি আমলে হজযাত্রীর কল্যাণে নানান অবদান রাখেন। বৃহত্তর চকরিয়ার জমিদার ওয়ায়েজ উদ্দিন মুহুরী, হাটহাজারী কাটির হাটের মাওলানা ইয়ার মুহাম্মদ তুর্কি আমলে হজ করার পাশাপাশি ফিলিস্তিন বাগদাদ সফর করেন।

শিল্পজগতের পথিকৃৎ এ.কে. খানের কৃতি সন্তান জনাব সালাউদ্দিন কাশেম খান দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত তুরস্কের অনারারি কনসাল জেনারেল। আমারও পর পর তিনবার তুরস্ক সফর করার সুযোগ হয়। সংবাদপত্রে তুরস্ক নিয়ে লেখালেখি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তুরস্কের উপর আমার পর পর দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। একটির নাম: ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের দেশ তুরস্ক। আরেকটির নাম: ইস্তাম্বুল কোনিয়ার পথে প্রান্তরে। এই দুটি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়। অপরদিকে তুরস্কের উপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি গ্রন্থের কাজ চলমান। গ্রন্থটির নাম: সংবাদপত্রে তুরস্কের শত প্রবন্ধ। সেই মতে তুরস্কের উপর শতের অধিক প্রবন্ধ সংবাদপত্রে “তুরস্কের শত প্রবন্ধ” নামকরণে আমার রচিত একটি গ্রন্থের কাজ অনেকটা সমাপ্তির পথে। যা চলতি অক্টোবর মাসে ২৯ তারিখ তুরস্কের শত তম জাতীয় দিবসকে সামনে রেখে গ্রন্থ প্রকাশ করার আশা রাখছি। গ্রন্থটির প্রকাশক হিসেবে অবদান রাখছেন তুরস্কের অনারারী কনসাল জেনারেল জনাব সালাউদ্দিন কাশেম খান।

জনাব সালাউদ্দিন কাশেম খানের আমন্ত্রণে তুরস্কের মাননীয় রাষ্ট্রদূতগণ আন্তরিকতার সাথে গুরুত্ব দিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। ঐ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের মাননীয় রাষ্ট্রদূতগণ খুবই মনোযোগ সহকারে আমার মুখ থেকে তুর্কি সালতানাতের সাথে চট্টগ্রামের সম্পর্কের কথা শুনতে আগ্রহ প্রত্যক্ষ করি। বিশেষ করে ২০১১ সালে জনাব বাকুর এরকুল, ২০১৪ সালে জনাব হোসাইন মফতুগুলু, ২০১৬ সালে জনাব ডেবরিন অসতুরক, ২০২১ সালে জনাব মোস্তফা ওসমান তুরান ও চলতি ২০২৩ সালের ১১ জুলাই বর্তমান রাষ্ট্রদূত রামিস সেন এর সাথে।

বস্তুতঃ তুর্কি সুলতানগণ দীর্ঘ প্রায় ৫/৬ শত বছর বিশ্ব মুসলিমের অভিভাবক ছিলেন। ছিলেন উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য গর্বের বিষয়। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় তাদের ৪/৫ শত বছরের খেদমত স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অপরদিকে চট্টগ্রামের সাথে শীপইয়ার্ড আরবীয়গণের চট্টগ্রামে আসাযাওয়া এবং পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার মাধ্যমে চট্টগ্রামের সাথে তুরস্কের আলাদা যোগসূত্র মূল্যায়ন ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাবার নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআলোকে আলোকময় শাহানশাহ্‌
পরবর্তী নিবন্ধভাইয়ের ছিনতাই করা পণ্য নিজের বলে বিক্রি করে বোন