এস এম সুলতান নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া এক নিষ্পেষিত কৃষক পরিবারে ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ মেসের আলী পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি হলেও মূল পেশা ছিল কৃষি। মাতার নাম মোছাম্মৎ মেহেরুননেসা। এস এম সুলতানের পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। পারিবারিক ডাকনাম ছিল লাল মিয়া। ১৯২৮ সালের কথা, তাঁর দরিদ্র পিতা এস. এম. সুলতানকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট ইশকুলে ভর্তি করে দেন। ইশকুলে পাঁচ বছর পেরোতে না পেরোতে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশুনা।
ইশকুল ত্যাগ করার পর শিল্পী তাঁর বাবার কাজে সাহায্যে করতেন কখনো মাঠে, খেত–খামারে কখনো–বা রাজমিস্ত্রির কাজে ব্যস্ত থাকতেন। রাজমিস্ত্রির কাজ দিয়ে তাঁর তুলির আঁচড় শুরু বিভিন্ন দালানে ছবি আঁকা, নকশা করে বেড়াতেন। মাত্র দশ বছর বয়সে একদিন ইশকুল পরিদর্শনে আসেন ডা. শাম্যাপ্রসাদ মুখার্জী। শিল্পী তাঁর ছবি এঁকে সবাইকে মুগ্ধ করেন। শিল্পী সুলতানের ইচ্ছা ছিল কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শিখবেন। নড়াইলের লোহাগড়ার জমিদার ধীরেন্দ্র নাথ রায়ও তাঁর প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। ১৯৩৮ সালের দিকে এস এম সুলতান কলকতায় চলে যান এবং ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের কলকাতার বাসায় ওঠেন। সে সময় তিনি কলকাতা আর্ট কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভ করেন। এস এম সুলতানের প্রতিভা দেখে তিনি তাঁর গ্রন্থাগার উন্মুক্ত করে দেন এবং বিভিন্নভাবে তাঁকে সহযোগিতা করেন। এক সময় এস এম সুলতান কলকাতা আর্ট ইশকুলে ভর্তি হন। আর্ট ইশকুলে পড়ালেখা শেষ করে তিনি ফ্রিল্যান্স শিল্পীর জীবন শুরু করেন। এস এম সুলতান ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। তাঁর সংগ্রহশালা গাছগাছালি, ফুল ফলে লতায় পাতায় ভরা। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি বেরিয়ে পড়েন উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে। শহরের অলিতেগলিতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি আঁকতেন। রণক্ষেত্রের ও বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক ও গ্রামবাংলার ছবি প্রদর্শনী ও বিক্রি করে চলত শিল্পীর জীবন। সিমলায় ১৯৪৬ সালে এস এম সুলতানের প্রথম আঁকা ছবির চিত্র প্রদর্শনী হয়। তিনি ছবি আঁকার জন্য ছুটে যেতেন কখনো কাশ্মীরে কখনো–বা পাঞ্জাবে কখনো–বা করাচিতে। করাচিতে তিনি দু বছর শিক্ষকতাও করেন। ১৯৫০ সালে তিনি আমেরিকায় চিত্রশিল্পীদের এক সম্মেলনে যোগ দেন। নিউইর্য়ক, বোস্টন, শিকাগো, ওয়াশিংটন এবং পরে লন্ডনেও তাঁর চিত্র প্রদর্শনী হয়। এ রূপগঞ্জের সংগ্রহশালায় যখন প্রবেশ করছিলাম তখন বিকেল তিনটা, সংগ্রহশালার পাশে চিরতরে শুয়ে আছেন এস এম সুলতান, পাশে নানা রকমের ফুলের বাগান। বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটি বর্ষীয়ান আম বৃক্ষও চোখে পড়ল। মাঝে মাঝে টুপটাপ আম ঝরে পড়ছে। সংগ্রহশালার ভিতরে প্রবেশ করে চোখ আঁতকে উঠল। শিল্পী এস এম সুলতানের তুলির আঁচড় এত সুন্দর! দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছি আর ভাবছি। এ যেন এক একটা জীবন্ত ছবির দুর্গ, ছবির ক্যাম্পাস। চটের উপর, দেওয়ালে, কাগজে অসাধারণ তুলির আঁচড়, তাঁর সৃষ্টি তাঁকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁর ছবিতে গ্রামীণ পরিবেশ। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপন থেকে শুরু করে কৃষক, গ্রাম্য মহিলাদের কাজকর্ম, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের বিদ্রোহের প্রতিবাদ, ঝড় জলোচ্ছ্বাসের সাথে কীভাবে টিকে থাকতে হয় সংগ্রাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কৃষকদের মধ্যে কেউ রুগ্ন, কেউবা বাহুবলী এবং সোনার ফসল ফলা মাটির সাথে সারাক্ষণ যাদের যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। দেশের সোনার মানুষ কৃষকদের জীবনসংগ্রাম, ঢেঁকি দিয়ে ধান ভাঙার দৃশ্য, গ্রাম্য নারীর গাভির দুধ দোহনের দৃশ্য, বাঙালির ইতিহাস, লোকসংস্কৃতিসহ আরও কত কী। বিশেষ করে তাঁর ছবিতে প্রাণবন্ত ও নিষ্পেষিত মানুষের জীবনযাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি বৈষম্যের বাস্তব চিত্র, চরদখল ও হত্যাযজ্ঞসহ আরও গ্রামবাংলার নানা চিত্রকর্ম তিনি তাঁর মেধায় মননে বংতুলি দিয়ে সমাজের এক বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। যা আজ সবকিছু সোনালি অতীত স্মৃতির ঝাঁপিতে যেন সবকিছু সাজানো এক সংগ্রহশালা। শিল্পী জল রং এবং চটের উপর কখনো–বা পটচিত্রের উপর এঁকেছেন বেশি। মাঝে মাঝে ক্যামেরায় তোলা শিল্পীর মাথাভরতি বাবরি কাটা মাথায় চুল কখনো–বা বাঁশি হাতে ছবি তুলেছিলেন সেই ছবিও তাঁর সংগ্রহশালায় শোভা পাচ্ছে।
১৯৭৬ সাল পর্যন্ত শিল্পী অনেকটা পর্দার আড়ালে ছিলেন বলা যায়। পরবর্তীতে এক সময় তাঁর কিছু ভক্ত তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সে সময়ে বাংলা একাডেমিতে শিল্পী সুলতানের একটি প্রদর্শনীও হয়। এ প্রদর্শনী দেখে অনেকে মুগ্ধ হন এবং শিল্পী নতুন পরিচয় লাভ করেন। ১৯৮০’র দশকের দিকে শিল্পী অনেকটা নড়াইলে থেকে যান। শিল্পী এস এম সুলতান শিশুপ্রেমীও ছিলেন। শিশুদের নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল বেশ। চিত্রা নদীতে নৌকায় করে শিশুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি শিশুদের জন্য আনন্দজগৎ খুঁজে বেড়াতেন। এক সময় তিনি নড়াইলে নন্দন কানন নামে একটি প্রাইমারি ইশকুল, একটি হাই ইশকুল ও একটি আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পী তাঁর শেষ বয়সে এসে তাঁর স্বপ্ন শিশুদের জন্য শিশু স্বর্গ ও চারু পীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে তাঁর বাড়িতে শিশুদের বিনোদনের জন্য তিনি বিভিন্ন জীবজন্তু দিয়ে একটি চিড়িয়াখানা বানিয়ে দেন। সোনার বাংলা বিনির্মাণে শিশুরাই আগামীতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে সেকথাই তিনি তাঁর মন মন্দিরের ক্যানভাসে তুলি দিয়ে এঁকেছেন। ১৯৮২ সালে নড়াইলের কিংবদন্তি–পুরুষ এস এম সুলতানকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘এশিয়ান ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮২ সালে এস এম সুলতানকে একুশে পদক, ১৯৮৫ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। ১০ অক্টোবর খ্যাতিমান এ চিত্রশিল্পীর ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।