ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্পের বিকাশে অনেক অন্তরায় রয়েছে। শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্পের (এসএমই) পাঁচটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো– সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, নীতি ও নিয়ন্ত্রকের সমস্যা, অর্থায়ন, অবকাঠামো এবং দক্ষতা। এগুলোর সমাধানে কার্যকর দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন, আর্থিক ও নীতি সহায়তা প্রদান, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রম আইনের সংশোধন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া জরুরি।
সেমিনারে প্রধান অতিথি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। যদিও এ খাত নানামুখী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। এ সমস্যা নিরসনে নীতি সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এসএমই খাতে জামানতবিহীন ঋণ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এ বিষয়ক তথ্যাদির যথাযথ প্রচার–প্রচারণার অভাবে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, এসএমইদের সার্বিক সহায়তা নিশ্চিতকল্পে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’–এর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। এছাড়া এসএমইদের রপ্তানির পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান নির্ধারিত শুল্ক হার হ্রাসের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। মূলপ্রবন্ধে ড. সেলিম রায়হান বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা প্রধানত সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, আর্থিক ও নীতি সহায়তা, যথাযথ অবকাঠামো এবং দক্ষ মানবসম্পদের স্বল্পতার মুখোমুখি হবেন। এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এমএসএমইর পণ্য উৎপাদননির্ভর করবে বাজারের সার্বিক চাহিদার ওপর। চাহিদাকে চাঙ্গা রাখতে সহায়ক–এমন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সময়টা অস্থির, কিঞ্চিৎ অনিশ্চিত। সামপ্রতিককালের চিন্তিত অর্থনৈতিক অবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তার কালোছায়া যুক্ত হয়েছে। বিষয়টা ভাবতে হবে সবাইকে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপের সময় এসে গেছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সার্বিকভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ খুব একটা ঘটেনি। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অবদান এসএমই খাতের। কিন্তু আমাদের এসএমই খাত আদৌ ২০ শতাংশ অবদান রাখছে কি না আমার সন্দেহ আছে। ওইসিডিভুক্ত ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলোর জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৫৫ শতাংশ। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর অবদান ৪৫ শতাংশের মতো। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখছে এসএমই খাত। বেশিরভাগ কর্মসংস্থানও তাদের এসএমই খাতে। সুতরাং বৃহৎ শিল্প বা বৃহৎ বাণিজ্যের অবদানকে আমরা যেভাবে বড় করে দেখি বা নির্ভর করি তা ভুল। আর বৃহৎ শিল্পের প্রতি সাধারণ ঝোঁকটা এসএমই খাতের প্রতি অবহেলাও একটা কারণ। বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শ্রমিক এসএমই খাতে জড়িত। সুতরাং এসএমই খাত যত বড় হবে, কর্মসংস্থান পরিধিও তত বড় হবে। তারপরও আমরা যেভাবে এসএমই খাতকে অবহেলা করি, তা উন্নত দেশগুলো করে না।
আসলে বড় বড় শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খানিকটা নয়, অনেকটাই অবহেলিত। আমরা যে আর্থসামাজিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হতে পারে আমাদের বড় ভরসাস্থল, এক বিরাট চালিকাশক্তি। এসএমইতে আমরা কেন এত গুরুত্ব দেব? ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, গুরুত্ব দেওয়ার কারণগুলো হচ্ছে– প্রথমত, এসএমএই খাতে বর্তমানে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত। দ্বিতীয়ত, এই খাতের দ্রুত বিকাশ লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তৃতীয়ত, এসএমই খাতের পণ্য গুণে–মানে কোনো অংশেই কম নয়। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর। এ খাত আয়বর্ধক খাত হিসাবে চিহ্নিত। যারা চাকরি করতে চায় না বা করে না, শিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত–তাদের সবারই একটা সুযোগ থাকে এখানে কিছু করার। চতুর্থত, কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটা বড় সুযোগ ও ক্ষেত্র হচ্ছে এসএমই খাত। সার্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের বড় একটা হাতিয়ার এটা। আমাদের সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও এই খাতের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নানা উদ্যোগ ও কথাবার্তার পরও কেন এ খাত অবহেলিত এবং এর বিকাশে কী কী করা প্রয়োজন সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে এসএমই খাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করাটাও জরুরি।