গোটা দেশ স্তম্ভিত, হতবাক! যা কোনদিন ঘটেনি তাই সমপ্রতি ঘটলো উত্তর সাগর পাড়ের আপাত শান্ত এই দেশটিতে। এর আগেও এদেশে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিনের আলোয়, ক্লাস চলাকালীন নিজ শিক্ষককে হত্যা করার ঘটনা যদ্দুর জানি এই প্রথম। যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি কেবল শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন জিপি অর্থাৎ ডাক্তারও। গেল সপ্তাহে হল্যান্ডের বন্দরনগরী রটারডামের এরাসমাস মেডিকেল সেন্টারে আধুনিক অস্ত্র হাতে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করলো কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র, তারই ৪৩ বছরের ডাচ শিক্ষককে। বিদেশি বংশোদ্ভূত এই ছাত্রের নাম ফুয়াদ এল। উত্তর আফ্রিকীয় এই ছাত্র খুব সম্ভবত মরক্কো কিংবা তিউনিসিয়ার নাগরিক। পুলিশ এখনো তার পুরো পরিচয় প্রকাশ করেনি। এই তথ্য জানা গেছে মেডিকেল সূত্রে। ফুয়াদ কেবল তার শিক্ষককেই হত্যা করেনি, তাকে হত্যা করার খানিক আগে তার প্রতিবেশী ৩৯ বছরের ডাচ মহিলা ও তার ১৪ বছরের কন্যাকে গুলি করে হত্যা করে। সে যখন তার শিক্ষককে হত্যা করে তখন তিনি ক্লাস নিচ্ছিলেন। কেবল তাই নয়, উন্মাদ এই ছাত্র তার প্রতিবেশি ও তার নিজ ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এই অঘটন ঘটিয়ে ঘাতক–ছাত্র লুকিয়ে ছিল মেডিকেল সেন্টারের হ্যালিপ্যাডের নিচে। পুলিশ তাকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে। নিহত ডাক্তারের নাম যুর্গেন দামেন, তার এক কন্যা ও স্ত্রী।
মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্র ফুয়াদ কেন এমন ঘটনা ঘটালো– সবার মনে এই প্রশ্ন। ঘটনার দিন থেকে শুরু করে দিন কয়েক ডাচ টিভি ও রেডিও চ্যানেলে এই নিয়ে চলে জল্পনা–কল্পনা। হত্যাকাণ্ডের পর জানা যায়, ফুয়াদের বিরুদ্ধে এর আগে পুলিশী রিপোর্ট ছিল। তার আচরণ স্বাভাবিক ছিলনা। তার বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় খরগোশ হত্যার অভিযোগ ছিল। হল্যান্ডে কুকুর অত্যন্ত প্রিয় প্রাণী। প্রায় ডাচ ঘরে এই প্রাণীটির দেখা মেলে। তাদেরকে নিজ সন্তানের মত আচরণ করা হয়। রাস্তায় পথ চলতে কোন কুকুরকে যদি আপনি লাথি মারেন বা তাড়িয়ে দেন তাহলে তা ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়না। ফুয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সে কুকুরের প্রতি এই ধরনের আচরণ করতো। ঘটনার দিন টিভি সংবাদে এক সাক্ষাৎকারে ফুয়াদের এক প্রতিবেশি বলেন, ‘খরগোশ হত্যা করার পর আমি তার কাচের জানালায় হাতের আঙুলের রক্তমাখা ছাপ দেখেছি। আমি পুলিশকে বলেছিলাম, আজ সে হত্যা করেছে পশুদের, কদিন পর মানুষ হবে তার টার্গেট, এখন তাই হলো। এছাড়া সে বাগানে অনেকটা উলঙ্গ অবস্থায় বসে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করতো, ড্রাগস্ ব্যবহার করতো।’ তার এই ধরনের উদ্ভট আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তার আক্রমণের শিকার ডাচ মহিলা। জানা যায়, মহিলা বাসা থেকে বের হতে ভয় পেতেন তার উগ্র আচরণের কারণে। ফুয়াদের ধারণা ওই মহিলা ভিডিও করে পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিল বলে সে পুলিশের কাছে চিন্তিত হলো। আর সে কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে মহিলাকে হত্যা করে। পুলিশ এর আগে তার বিরুদ্ধে এই জাতীয় অভিযোগ পাবার পর মেডিকেল হাসতাপাল–কলেজ কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলে, তাকে ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেবার আগে তার আচরণ ও মানসিক ভারসাম্য পরীক্ষা করা দরকার। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ ফুয়াদকে বলে, ‘ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেবার আগে তোমাকে সাইকোলোজিকেল টেস্ট দিতে হবে।’ এতে সে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং ফেসবুকে সে লিখে আমার জীবনটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। যিনি তার মানসিক ভারসাম্য পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি হলে ডাক্তার যুর্গেন দামেন। তাকে সে টার্গেট করে এবং আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ছাত্রদের সামনে হত্যা করে। হত্যা করার আগে শিক্ষকের দিকে অস্ত্র তাক করে তার নাম ধরে বলতে থাকে, তোমার দিন শেষ।
যখন এই ঘটনা ঘটলো ও প্রকাশ পেলো তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন এটি কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। হল্যান্ডে এই ধরনের ঘটনা বিরল বলা চলে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় হল্যান্ডে সন্ত্রাসী ঘটনা কম। তবে ঘটনা যে একেবারে ঘটে না তা দাবি করা যায় না। ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ সকালে উত্রেক নামক এক শহরে এক উগ্রপন্থী মুলসিম বন্দুকধারী ট্রামে হামলা চালিয়ে চার নিরীহ যাত্রীকে হত্যা করেছিল। এদের মধ্যে একজন দশদিন পর হাসপাতালে মারা যান। ওই আক্রমণে ছয় যাত্রী আহত হয়েছিলেন। ওই সন্ত্রাসী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তুর্কি বংশোদ্ভূত ৩৭ বছরের এই উগ্র সন্ত্রাসী গোকমেন তানিসকে ‘সন্ত্রাসী অভিপ্রায়ে হত্যার’ দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিচারে এই ঘটনাকে ইসলামী চরমপন্থার একটি কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তুরুস্কে বড় হওয়া তানিস ১৯৯৩ সালে তার বাবা–মা এবং দুই ভাইয়ের সাথে হল্যান্ড আসে। পারিবারিক অশান্তিও ছিল তানিসের। তার বাবা–মা ২০০৮ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ করেন এবং তারপর থেকে সে তার বাবার সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। এক সময় হার্ড ড্রাগসে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং তার পরিবার এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, যখন সে মাদক সেবন করত তখন সে খুবই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতো এবং অন্যান্য মাদক সেবনকারীদের সাথে তার মিথস্ক্রিয়া ছাড়াও তাকে প্রায় সবসময় একাই দেখা যেত। তার আসক্তির মধ্যবর্তী সময়ে সে তার ইসলামী বিশ্বাসের উপর বেশি মনোযোগ দেয় বলে জানা যায়। মাস কয়েক আগে হেগ শহরে আমার বাসা থেকে মিনিট দশেকের হাঁটার দূরত্বে এক স্ন্যাকসের দোকান ১৫ বছরের এক মরক্কীয় মেয়ে ও কাছাকাছি একই বয়েসী ছেলে দোকানের এক চৈনিক কর্মচারীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এই ধরনের ছিটেফোঁটা অঘটন হল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে ঘটে চলেছে এবং দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই সমস্ত ঘটনার পেছনে রয়েছে ভিন্ দেশ থেকে আসা লোকজন এবং এখানে জন্ম ও বড় হয়ে উঠা তাদের সন্তানেরা।
আজ থেকে ৩২ বছর আগে যখন হল্যান্ড আসি সে সময় এই দেশটি ছিল এটি নিরাপদ দেশ। চুরি, ডাকাতি, এই ধরনের হত্যাকাণ্ড, গোলাগুলির মত ঘটনা ঘটতো না। তখন বিদেশির সংখ্যাও ছিল কম। একবার ট্রামে ভুলে ব্যাগ ফেলে এসেছিলাম। সে কথা ট্রামের হেড অফিসে জানালে ওরা জানতে চায় কটার দিকে ট্রামে চড়েছি এবং কয় নম্বর ট্রাম ছিল, ব্যাগ দেখতে কেমন ইত্যাদি। ক্ষণিক বাদে জানালে, ব্যাগ পাওয়া গেছে। সেটি অফিসে আছে। সেখানে গিয়ে ব্যাগটি নিয়ে আসি। এখন ব্যাগ পাওয়া তো দূরের কথা, অনেক সময় মহিলাদের হাত থেকে ব্যাগ টেনে নিয়ে যায়, স্কুটারে আসা তরুণ। এবং এই অপকর্মের হোতা প্রায় ক্ষেত্রে মরক্কীয় ছেলেরা। অটোমেটিক মেশিন থেকে টাকা তুলতে আসা বয়স্কদের ব্যাংক পাস নিয়ে টাকা তুলে চম্পট দিয়েছে এমন ঘটনা ইদানিং হরহামেশাই ঘটে। বয়স্কদের বাড়িতে খাবার অর্ডার বা পোস্ট ডেলিভারি দেবার উছিলায় জোর করে ঘরে ঢুকে ঘরে থাকা অর্থ, স্বর্ণালংকার, ব্যাংক পাস নিয়ে যাবার ঘটনা হল্যান্ডের একটি টিভি চ্যানেলে নিয়মিত দেখানো হয়। তাতে ভিডিও ক্যামেরায় উঠে আসা অপরাধীর ছবি দেখানো হয়। আবেদন জানানো হয়, পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে। কখনো সখনো অপরাধী ধরা পড়ে, বেশির ক্ষেত্রে ধরা পড়ে না। তারপরও বলতে হয়, হল্যান্ডে বড়সর অপরাধ খুব একটা ঘটেনা। অপরাধীর অভাবে গত ১৩ বছরে হল্যান্ডের অনেক জেল খালি হয়ে গেছে এবং তার বেশ কয়েকটি ইউরোপের অন্যান্য দেশকে ‘ভাড়া’ দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু জেলখানাকে থিয়েটার হল, ছাত্রদের হোস্টেল বানানো হয়েছে। এই ব্যাপারটি ‘ইউনিক’ এবং ইউরোপের আর কোন দেশে এমনটি নেই। এর কারণ হিসাবে যা জানা যায় তা হলো, ক্রাইম রেইট এবং সম্পদের বল্টন– এই দুইয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমেরিকা ও ব্রাজিলের উদাহরণ তুলে ধরে ওই রিপোর্টে বলা হয়, ওই দুটি দেশে দেশের সম্পদ রয়েছে অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে। সম্পদ থেকে বঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। আর সে কারণে অপরাধের মাত্রাও বেশি। অন্যদিকে হল্যান্ড এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে যেমন ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনে সম্পদের এই বৈষম্য নেই। আর সে কারণে অপরাধের মাত্রাও কম। তদুপরি, হল্যান্ডে অপরাধী যাতে পুনরায় সমাজে ফিরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারে সেই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। আর জেলখানার ভেতর রয়েছে নিজেকে শুদ্ধ করার মতো যাবতীয় ব্যবস্থা। জেলখানায় আপনি চাইলে আপনার পোষা কবুতর, পাখিও আপনার কামরায় রাখতে পারেন। প্রতি দুই বছর পর পর বিচারক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে অপরাধীর সাজা কমানো বা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেন।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট