যুগ যুগ ধরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। পাশাপাশি বৃক্ষ নিধনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পরিবেশ দিন দিন তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য যেমন ধ্বংস হচ্ছে, যুগপৎভাবে বাস্তুসংস্থানও ভেঙে পড়ছে। বৃক্ষের মতো নি:স্বার্থ বন্ধুর প্রতি মানবজাতির বৈরী আচরণ আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বৃক্ষ আমাদের প্রাণ রক্ষা করে, নির্মমভাবে সে বৃক্ষ নিধনে আমরা ভীষণ তৎপর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) ‘দ্যা স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফরেস্ট –২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৪.১ শতাংশ যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বৃক্ষ নিধনের ফলে বনভূমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বৃক্ষের ওপর নির্ভরশীল। বৃক্ষ নিধন করতে গিয়ে মূলত আমাদের আত্মঘাতী কার্যকলাপে আমরা নিজেদের নিধন করে চলেছি। একটি প্রচলিত উক্তি আছে ” যারা বৃক্ষ রক্ষা করতে পারবেনা তারা শিগগিরই এমন একটা পৃথিবীতে বাস করবে যা মানুষকে ধরে রাখতে পারবেনা “। তাই এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে দ্রুত এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার কারণে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনেও বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার ফলে অনাবৃষ্টি, খরা, অসময়ে অতিবৃষ্টি, প্রচন্ড দাবদাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনবরতই ঘটে চলেছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই জীবন রক্ষাকারী বৃক্ষ যুগ যুগ ধরে সবুজ পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে আসছে। বেঁচে থাকার অন্যতম সহায়ক বৃক্ষ আমাদের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। জনসংখ্যার চাপে দিন দিন মানুষের জন্য নতুন আবাসস্থলের প্রয়োজন। এরই প্রেক্ষাপটে অসচেতনভাবে মানুষের হাতে প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন প্রক্রিয়াটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবহাওয়াও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান–ভারত স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের দেশের মোট আয়তনের ২৪ শতাংশ বনভূমি ছিল। ১৯৮০–৮১ খ্রিস্টাব্দে তা হ্রাস পেয়ে ১৭.২২ শতাংশে পৌঁছে এবং বর্তমানে আমাদের দেশে মাত্র ১০ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। ভবিষ্যতে বৃক্ষ নিধনের হার বেড়ে গেলে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। গাছ কিন্তু পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও অনুজীবের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিবেশ রক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। নির্বিচারে বন বনানী ধ্বংসের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখি বেঁচে থাকার আশ্রয়স্থল হারিয়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে। কবির ভাষায় বলতে হয় ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃ কোলে’। প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীন পরিবেশ ও বন উজাড় হওয়ার কারণে অতি সাধারণ প্রাণী যথা বানর, হনুমান, কাটবিড়ালি, খরগোশ, শিয়াল, বেজী, চিল, শকুন, ডাহুক, বনমোরগ, বাঘ, হরিণ, হাতিসহ অনেক পশুপাখি আগের মতো দৃশ্যমান নয়, এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পশুপাখির সংখ্যা হ্রাস বা বিলুপ্তির পথে। বিশেষজ্ঞদের মতে বনাঞ্চল সংকুচিত হওয়াটা আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। নির্বিচারে বন নিধন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। কাঠচোররা অসচেতনভাবে প্রতিদিন অনেক বৃক্ষ কেটে বন বনানী ধ্বংস করে চলেছে। অনেক সময় বৃক্ষ রোপণ করা হলেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রত্যাশিত হারে বনানী সৃজন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত বনভূমি ও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে পরিবেশের ওপর বিপদ নেমে আসে। মানুষের অমানবিক অত্যাচারে প্রকৃতি যেন রুদ্ররূপ ধারণ করেছে। অবাধ বৃক্ষ নিধন ও অবিবেচনা প্রসূত পাহাড় কাটার কারণে প্রকৃতিও প্রায় সময় বৈরী হয়ে উঠে যার ফলে কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড় ও অকাল বন্যা প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। বৃক্ষরাজি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃক্ষরাজির অবস্থান শব্দ দূষণ রোধে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দদূষণ রোধ করতে পারে।
বন নিধন বলতে নির্বিচারে ব্যাপকভাবে বৃক্ষ কর্তনকে বুঝায়। বর্তমানে এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যাও বটে। তবে বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বন উজাড়করণ বা বৃক্ষ নিধনের কাজটি ব্যাপক হারে ঘটে থাকে। বিভিন্ন বিষয় মাথায় নিয়ে মানুষ বৃক্ষ নিধনযজ্ঞে জড়িয়ে পড়ে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বন উজাড়করণের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষ বৃক্ষ কেটে বনভূমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে । দ্রুত গাছপালা কেটে ফেলার কারণে মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর উপর প্রকৃতির ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে থাকে। বৃক্ষ নিধন বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টি করে পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জলবায়ুর উপর বৃক্ষ নিধনের ক্ষতিকর প্রভাব বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন বৃদ্ধিতে পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব ভীষণ ভাবে দায়ী। কারণ জলবায়ুর এ প্রভাব সমুদ্রের উচ্চতাকে এক ভীতিকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ লাগিয়ে বনাঞ্চল সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে বিশ্বের জনগণ এবং সরকার প্রধানগণ এ বাস্তব সত্যটি অনুধাবন করতে শুরু করেছেন। তাই লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মরু অঞ্চলে বালুর পাহাড়ে বৃক্ষ চারা রোপণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে বনাঞ্চল সৃষ্টি করে যাচ্ছে। মরুময় এসব দেশে বৃক্ষ সৃজনের কল্যাণে আগের তুলনায় আশাতীতভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। নিত্যদিনের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় শাকসবজি আজ তারা নিজেরাই উৎপাদন করে আসছে। আসলে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অভাবনীয় ও অপরিসীম। বৃক্ষ বিভিন্ন উপায়ে কার্বনডাইঅক্সাইড চুষে নিয়ে পরিবেশকে সজীব রাখে এবং পৃথিবীকে মানুষ ও প্রাণীদের বাসযোগ্য রাখতে সহায়তা করে। এই বৃক্ষই আমাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে অঙিজেন সরবরাহ করে থাকে। বৃক্ষ আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজন পূরণে বিরাট সহায়ক। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমরা অসচেতনভাবে প্রতিদিনই বৃক্ষ নিধন করে চলেছি। নগর উন্নয়ন মোটেও অযৌক্তিক ও অর্থহীন কিছু নয় তবে অবিবেচনাপ্রসূত আবেগে নির্বিচারে বৃক্ষ কেটে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা আদৌও সমীচীন নয়। জরিপে দেখা যায় বিগত দশকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। যার কারণ হিসেবে পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা অপরিকল্পিত ভাবে বৃক্ষ নিধনকে দায়ী করেছেন। একটি চীনা প্রবাদে উল্লেখ আছে, ‘আপনি যদি এক বছরের জন্য পরিকল্পনা করেন তাহলে ধান লাগান। যদি ১০ বছরের জন্য পরিকল্পনা করেন, তাহলে বৃক্ষ রোপণ করেন। আর যদি সারাজীবনের জন্য পরিকল্পনা করেন তাহলে জনগণকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করেন’।
১০ বছর বা তারও অধিক সময়ে একটি বৃক্ষ আপনার কাছে একটা বড় সম্পদে পরিণত হবে। বৃক্ষের জন্ম প্রাণীকুলের উপকার ও কল্যাণের জন্য। অক্সিজেন ছাড়াও বৃক্ষের কাছ থেকে আমরা খাদ্য পাই, জ্বালানি পাই, আশ্রয়ের জন্য বাসস্থান পাই, বৈদ্যুতিক খুঁটি পাই, বৈচিত্র্যময় আসবাবপত্র পাই এবং আরও নানান ভাবে বৃক্ষ আমাদের উপকারে আসে। আমরা কংক্রিটের সৌন্দর্য বাড়াতে গিয়ে প্রাকৃতিক শোভা ধ্বংস করি। বৃক্ষ নিধন রোধে সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং জনগণকে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে নতুবা আমাদের পরিবেশ অচিরেই ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে পরিবেশ রক্ষায় দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের আয়তনের তুলনায় বনভূমির পরিমাণ ১০ শতাংশেরও কম। মিল কারখানা স্থাপন ও নগরায়ণের কারণে বৃক্ষ নিধন প্রক্রিয়াটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে বৃক্ষ নিধন চলতে থাকলে পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার ফলে আগামীতে এ বিশ্বে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী এবং বৃক্ষরাজির অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই যেকোনো মূল্যে বৃক্ষ নিধন রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বৃক্ষ নিধনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। আন্তরিকতা, সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ থেকে প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় সবাইকে যত্নশীল হতে হবে। বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বনাঞ্চল সৃজন ও সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট সকলকে হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর এতেই পরিবেশ রক্ষা পেলে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশেও জনগণের জীবন যাপন সুখী ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে উঠবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।