বুক পকেটে জমানো দুঃখ
নাহ সেটাই বা হয় কিভাবে? ঘুরতে তো এসেছি পরিবার নিয়ে। অতএব ভ্রমণে তাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ সেটাকেই তো গুরুত্ব দিতে হবে। ঐ বরফজমা লেইক দেখে দীপ্র ও অভ্র যেরকম আনন্দিত হয়েছিল, মিউজিয়মে ঢুকলে বা বাগানে ঘুরলে কি তারা ওরকম আনন্দিত হতো? মনের ভেতরের দ্বিতীয়জন এ সময় কথা মনে করিয়ে দিতেই মানতে হল তা নির্দ্বিধায়। একইসাথে একটা ব্যাপার মনে পড়ায় বড়ই হাসি পেল সাথে রাগও হল তুমুল।
তা হলো ইউনেস্কো কর্তৃক সামার প্যালেসকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করা! ভাবখানা এমন যেন তেনারা এটা না করলে বুঝি চায়নিজরা এর গুরুত্ব বুঝতো না। মাছের মা’র পুত্রশোক আর বলে কাকে? নানান দেশ, জাতি ও সমাজের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়ে ইউনেস্কোর যদি অতোই মাথাব্যাথা থেকে থাকে, তাহলে দেখি তো তারা এশিয়া আফ্রিকা থেকে লুট করে নিয়ে যাওয়া প্রত্নসম্পদ যা দিয়ে বোঝাই ইউরোপিয় উপনিবেশিক লুটেরাদের দেশের যাদুঘরগুলো, দিক না ফিরিয়ে সেসব স্ব স্ব দেশে!
বেইজিংএর গ্রীষ্মকালীন বাগানবাড়ি মানে সামারপ্যালেস ভালমতো না দেখতে পারার অতৃপ্ত বাসনার লেজ ধরে এতোক্ষণের নানামুখি ভাবনার অকস্মাৎ ছেদ টেনে এ সময় মধুর স্বরে রুমের দরজাঘণ্টি বেজে উঠতেই ছাড়তেই হল চাটগাইয়া ভাষায় যাকে বলে সোফাকোয়াইশ মানে সোফায় শুয়ে থাকার আরাম।
দরজা খুলতেই দেখা মিললো আনন্দে ঝলমল পুত্রদ্বয়ের। হুড়মুড় করে রুমে ঢুকতে ঢুকতে দীপ্র বলল দেখো তো বাবা কেমন লাগছে আমাকে দেখতে?
কানে মাথায় লাগানো লাল রঙ্গয়ের হেড ফোন লাগিয়ে আই প্যাড থেকে মনে হচ্ছে গান শুনছে দীপ্র। ভাইয়ার এই কূলবয় হওয়ার যন্ত্র কেনার একনিষ্ঠ সমর্থক অভ্রও যদিও ঝলমল করছে আনন্দে, তারপরও মনে হচ্ছে ওর চেহারায় বুঝি হঠাত দেখতে পেলাম এক টুকরো বেদনার ছায়া। সাথে সাথে মনের ভেতর দরাজ কণ্ঠে কোন এক আবৃত্তিকার সুনীল গংগোপাধ্যায় যে লাইন গুলো আবৃত্তি করে গেল, সেই লাইনগুলো হল – “একটাও রয়েল গুলি কিনতে পারিনি কখনো/ লাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা/ভিখারীর মতন গেঁটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভেতরে চৌধুরীদের রাস উৎসব/ অবিরল রঙ্গের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পড়া ফর্সা রমণীরা কতো রকম আমোদে হেসেছে/ আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি।”
মহামানবদের কথা জানি না, আমার মতো সাধারনের মানবজীবন তো কখনোই নিরন্তর অবিরল আনন্দের নয়। এমনকি নয় তা “দোয়েলের শালিখের” ও! শৈশব যতই আজ হিরণ্ময় আর মধুর ঠেকুক না কেন, সুনিলের সেইসব দুঃখ তো অহরহই আমার শৈশবকে জড়িয়ে রেখেছিল অহোরাত্রি। কি করে যেন সেইসব দুঃখ, বেশীরভাগ সময়ই তুমুল সাবধানতায় আর যত্নে লুকিয়ে রাখতাম, কখনো বুকপকেটে কখনো বা পরানের গহীন ভেতর। যেহেতু সম্যক জানতাম আব্বার দুর্বল পকেটে অক্ষমতার খবর। বালকবয়সে একাত্তরের রক্ত, আগুন আর ধবংসযজ্ঞের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি সম্ভবত বয়সের চেয়ে ঢের বড় হয়ে গিয়েছিলাম, ঐসব বয়সেই অতএব আব্বা কখোনই টের পান নি আমার সেই সব সুগভীর সাগরনীল দুঃখের খবর। সুনিলের বেশীরভাগ দুঃখের সাথে আমারও অনেক মিল থাকলেও এ জায়গাটায় বড়ই অমিল । আমি তাই বলতে পারি না-“বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন দেখিস, একদিন, আমরাও”
এছাড়া আম্মা তো কখনোই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেও আশাবাদি ছিলেন না। তাই সে সময় জানতাম বুক পকেটে জমানো ঐ সব দুঃখ ছিল শুধুই আমার একান্তই নিজের। বড় হতে হতে অবশ্য জেনেছিলাম মানুষের সকল দুঃখই আসলে সব সময়ই একান্তই নিজের । আজ কি না এতো দিন পর বেইজিং শহরের এই হিমরাতে, হোটেল কক্ষের ওম ওম গরমের আরামের মধ্যে পকেট ভর্তি খুচরা পয়সার মতো সেইসব দুঃখ, ঝন ঝন করে জানান দিল অস্তিত্ব!
তাতেই অভ্রর চেহারায় এইমাত্র মনে হল দেখতে পেলাম শৈশবের আমার সেই দুঃখের ছায়া। হৃদয় মন মুচড়ে দেয়া একটা ব্যাথা টের পেলাম বুকে। মনে হল আচ্ছা, কেন আমি জিজ্ঞেস করিনি অভ্রকে যে ওর এই বিটস হেডফোন লাগবে কি না? আমাদের স্বাধীনতার পুরো সুফল ভোগ করতে পারা এই আমার প্রজন্মের তো তাদের আত্মজদের জন্য একটার জায়গায় দুটো বিটস হেডফোন কেনা অসম্ভব কোন ব্যাপার না। এ ব্যাপারে তো আব্বার চেয়ে যে আমি এগিয়ে আছি অনেক তা তো সত্য এবং তা অস্বীকার করার মতো অকৃতজ্ঞ তো আমি নই । নাহ, কালকের শপিং ডে তে সময় সুযোগ করে যেতেই হবে ফের অ্যাপেল স্টোরে। ওখানে অভ্রকে ফের নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো লাগবে কি তারও ভাইয়ার মতো ঐ কুল হেডফোন?
“বাবা, বাবা তুমি কি একটু শুনবে গানটা? দেখো কি চমৎকার সাউন্ড কোয়ালিটি।” সোফায় আমার পাশে বসে কানে মাথায় লাগানো বিটস হেডফোনে কি যে গান শুনছে দীপ্র, তার ছোঁয়া যন্ত্রের মগজ ছেনে তা তো শুনতে পাচ্ছি না? তবে বসে বসেই ওর হাত মুখ মাথা আর শরীরের যা নড়া চড়া দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে শুনছে সে কোন তুমুল তাল লয়ের গান। অবশ্যই হবে তা এখনকার কোন রক বা হেভি মেটাল ব্যান্ডের। যেসবের বেশীর ভাগকেই বেশীর ভাগ সময় আমার কাছে উদ্ভট চিৎকারই মনে হয় শুধু। তুমুল হেভি মেটালের আওয়াজে ওসবের কথার আগামাথা তো কিছুই বুঝি না।
এরই মধ্যে দীপ্র আমাকে গান শোনানোর জন্য হেড ফোনটা আমার হাতে হস্তান্তর করতেই, অভ্রকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তুমি কি এটা টেস্ট করে দেখেছো একবারও।
মাথা নেড়ে না সূচক জবাব পেতেই , একবার মনে হল দেই একটা বকা দীপ্রকে। সারাক্ষণ এই জিনিষ কেনার ব্যাপারে অভ্র তার তুমুল সমর্থক থাকার পরেও ওকে কি না সে একবারও তা দেয়নি এর মধ্যে। তবে সাথে সাথেই চিন্তাটা বাতিল করে দিলাম। এমন আনন্দময় একটা আবহের মধ্যে অযথাই মন খারাপ করার কোন কারণ তৈরি করার কোন মানেই নেই। নিজের কানে লাগানোর বদলে, অভ্রর হাতে সেই মহার্ঘ হেডফোন তুলে দিতেই ওর ঝলমলে হাসিতে গোটা রুম আলোকিত হয়ে উঠলো অন্যরকম হিরণ্ময় এক আলোয়। দ্রুত ও নিজের আইপড বের করে সেটিতে তা সংযুক্ত করে মাথার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শক্তপোক্ত লালপ্লাস্টিক ব্যান্ডের দুইপাশে যুক্ত দুই ইয়ার পিস দুই কানে লাগিয়ে শুনতে লাগল গান । মনে হল নিশ্চিত শুনছে সে মাইকেল জ্যাকসন।
ডিজিটাল সময়ের বাচ্চারা আজকাল সহজেই পেয়ে যাচ্ছে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের নানান স্টারদের হাতের নাগালে। তবে কেন যে ও বিশেষত ঐ মাইকেলের পাঁড় ভক্ত হয়ে উঠেছিল চার কিয় পাঁচ বছর বয়সে তা জানি না । সাথে এও মনে পড়ল জ্যাকসনের অকস্মাৎ সেই অকাল মৃত্যুতে কি গভীর বেদনায় ভুগেছিল। সব কিছু বাদ দিয়ে সেসময় সারাক্ষণই ও টিভি খুলে বসেছিল তার নায়কের শেষকৃত্যানুষ্ঠান দেখার জন্য। অবশ্য সে সব তো বছর ছয় সাত আগের কথা!
অভ্রর সেই জ্যাকসনপ্রীতির লেজ ধরে মনে পড়লো ফের সেই ঘটনাটা। ঘটনা হল জ্যাকসনের মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর, একদিন সম্ভবত ফিরছিলাম যখন ওর দাদা দাদি ও চাচার কবর জেয়ারত করে ঢাকায় সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত গোরস্থান থেকে, হঠাৎ ও আনমনে বলেছিল, বড় হয়ে নাকি সে মৃত মানুষ জীবিত করার পন্থা আবিস্কার করবে!
শুনে ওর কল্পনা শক্তিকে উস্কে দেবার জন্য বলেছিলাম, মানে কেউ যখন মারা যায়, তখনই সাথে সাথে তাঁকে জীবিত করবে এটাই তো? উত্তরে ও আনমনেই উত্তর দিয়েছিল যে নাহ যারা অনেক আগে মারা গেছেন তাদেরও ফিরিয়ে আনবে ও! খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি সে ক্ষমতা বা পন্থাও বের করতে পারে তবে কোন তিনজনকে প্রথমে জীবিত করবে। ধারণা করেছিলাম , সেই তিনজন হবে কিছুমাত্র আগে জেয়ারত করে আসা ওর দাদা , দাদি আর চাচার কথা বলবে বুঝি । আমার ধারণা সেদিন ৩৩.৩৩% সঠিক হয়েছিল। যে তিনজনের নাম ও সেদিন বলেছিল তরা মধ্যে প্রথম নামটি তার অদেখা চাচার হলেও বাকি দু’জন ছিলেন বঙ্গবন্ধু আর মাইকেল জ্যাকসন! ভির্মি খেয়ে গিয়েছিলাম সে উত্তরে!
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক