বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায় বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। দূষিত বায়ুতে আমাদের নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। দূষিত বায়ু আমাদের শরীরে নানা রকম রোগ সৃষ্টি করে থাকে। বায়ু দূষণের কারণে হাঁপানি, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যাসহ বহুরোগ হয়। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। এক পরিসংখ্যান বলছে গত বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী বায়ুদূষণ।
বায়ুদূষণ এর ফলে যে শুধুমাত্র আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা নই। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বায়ু দূষণের ফলে ওজন স্তর পাতলা হচ্ছে যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে ভয়াবহ দাবানল, অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছাস সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে।
এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স–২০২৩ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে দেশের নাগরিকদের গড় আয়ু ৬ বছর ৮ মাস বা পৌনে সাত বছর কমছে। আর বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু কমছে ২ বছর ৪ মাস। এছাড়া বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকতা বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকির বিষয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটালে ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৭ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার। অন্যদিকে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাইয়ে সেখানে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। আর চলতি বছরের জুলাইয়ে এ সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, সিসা দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে ১ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। এ কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে। তাদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। সংবাদ সম্মেলনে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বায়ুদূষণ সারা দেশে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছে। এ কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নাগরিক শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে বিকলাঙ্গ প্রজন্ম, প্রতিবন্ধী শিশু তৈরি করবে নাকি শিল্পপতিদের কাছে মাথা নত করবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ুদূষণ রোধের মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা বায়ু, পানিসহ পরিবেশগত নানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের খুব কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখি না যার ফলেই একটি দেশ বারবার দূষণে শীর্ষে। ২০১৯ সালে নামমাত্র ‘নির্মল বায়ু আইন’ করা হয়েছিল যার কোন কার্যক্রম আমরা দেখতে পাইনি। তাই নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং আইন যেন কাগজে সীমাবদ্ধ না থাকে সেইদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
তাঁরা বলেন, বর্তমানে বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত জনজীবনের চিত্র গণমাধ্যম এবং পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলেও এটা এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। প্রশাসন এবং জনগণ কেউই সচেতন নয়। বায়ুদূষণ রোধে জনসচেতনতা খুবই জরুরি। দূষণ রোধ করার জন্যে নগরায়নে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। শিল্প–কারখানা থেকে যেন বায়ুদূষণ না হয় তাই পরিবেশবান্ধব শিল্প–কারখানা নির্মাণ করতে হবে। নির্বিচারে গাছকাটা বন্ধ করে বনায়ন করতে হবে। ঢাকার রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে।
দূষণরোধ করার জন্যে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা যেকোনো দূষণ রোধ করতে পারে কিন্ত শুধুমাত্র সচেতন হয়ে এখন দূষণ রোধ করা সম্ভব না। পরপর চারবার বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছি আমরা দূষণরোধে এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বায়ুদূষণ রোধ করার জন্যে এখনই সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব আইন আছে, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাস্তাঘাট ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দূর করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দূষণরোধ করতে স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ী পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।