বাবাকে খুনের পর লাশ গুমের লোমহর্ষক বর্ণনা বড় ছেলের

খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে খুনের পর লাশ খণ্ডবিখণ্ড করে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় নিহতের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। বাবাকে খুনের পর দুই ভাই মিলে লাশ গুমের জন্য কেটে খণ্ডবিখণ্ড করার লোমহর্ষক তথ্য উঠে এসেছে জবানবন্দিতে।

জবানবন্দির তথ্যানুযায়ী, প্রায় ২৮ বছর নিখোঁজ থাকার পর ফিরে আসা ওই ব্যক্তি ভিটেমাটি বিক্রি করে দিতে চাইলে স্ত্রীসন্তানদের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে। এ নিয়ে ঝগড়ার মধ্যেই বড় ছেলে তার গলা টিপে ধরে। এতেই মারা যান ওই ব্যক্তি। পরে ঘটনা জানাজানি না হওয়ার জন্য দুই ভাই মিলে লাশ গুমের উদ্দেশে কেটে কয়েক টুকরো করে সেগুলো বিভিন্নস্থানে ফেলে দেয়।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম সাদ্দাম হোসেনের আদালতে নিহতের ছেলের দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য মিলেছে। খুনের শিকার মো. হাসান (৬১) বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নের বড়ইতলী গ্রামের সাহাব মিয়ার ছেলে।

নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খাঁন বলেন, হত্যা মামলার তদন্তে নেমেই আমরা নিহত ব্যক্তির স্ত্রী ও ছেলে মোস্তাফিজুরকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। আদালতের নির্দেশে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। আজ (বুধবার) মোস্তাফিজুরকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি স্বেচ্ছায় খুনের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর আদালতের নির্দেশে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের অদূরে ১২ নম্বর গেইটে একটি ট্রলিব্যাগ পাওয়া যায়। কফি রঙের ট্রলিব্যাগে ছিল মানব শরীরের ২ হাত, ২ পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত আটটি অংশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এর দুই দিনের মাথায় ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে নগরীর আকমল আলী সড়কের খালপাড়ে একটি খাল থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় টেপে মোড়ানো শরীরের আরেকটি খন্ড উদ্ধার করে পিবিআই। এছাড়া আঙ্গুলের ছাপ ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিচয়ও নিশ্চিত করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০) ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুরকে (৩২)

আদালত সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর জানান, প্রায় ২৮ বছর আগে তার বাবা হাসান চট্টগ্রাম শহরে যাওয়ার কথা বলে গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। দীর্ঘসময় নিখোঁজ থাকায় গ্রামের লোকজন প্রচার করে, তিনি মারা গেছেন। চরম অভাবের মধ্যে তার মা ছেনোয়ারাকে ভিক্ষায় নামতে হয়। শৈশব থেকে কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়েন মোস্তাফিজুর। ছোট ভাই সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে শহরে এসে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। ছোট বোন রাজিয়া বেগমকে বিয়ে দেওয়া হয়। হাসানের নিখোঁজ থাকার সুযোগ নিয়ে তার বড় ভাই ও স্ত্রী এবং এলাকার লোকজন মিলে মোস্তাফিজুরদের ভিটেমাটি ছাড়া করার জন্য অনেক অত্যাচারনির্যাতন করতো। দুই বছর আগে হাসান ফিরে আসেন। সাতআট মাস পর আবার ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যান। এ সময় স্ত্রীসন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে নিয়মিত বড় ভাই ও ভাবির সঙ্গে হাসান মোবাইলে কথা বলতেন। স্ত্রীসন্তানদের না জানিয়ে হাসান তার বসতভিটা বিক্রির জন্য ভাইভাবির মাধ্যমে চেষ্টা করতে থাকেন। তিন মাস পর বাড়ি ফিরে আসেন। তবে বাড়িতে ভাত খেলেও থাকতেন প্রতিবেশীদের ঘরে। প্রায়ই স্ত্রী ছেনোয়ারার সঙ্গে ঝগড়া করতেন। ১০১৫ দিন আবার বাড়ি ছেড়ে গিয়ে দেড় মাস পর ফিরে আসতেন। আবারও বসতভিটা বিক্রি করে দেওয়ার জন্য স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা শুরু করেন।

জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর আরও জানান, ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে ছেনোয়ারা নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেইট এলাকার জমির ভিলায় ছোট ছেলের বাসায় আসেন। হাসান ছেনোয়ারা ও ছেলে সফিকুরকে ফোন করে বসতবাড়ি বিক্রি করে দেবে বলে জানিয়ে এক পর্যায়ে বলে, তোরা আমার সন্তান না। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে সাড়ে ১১টার দিকে হাসান সফিকুরের আসায় আসেন। বাসায় ছেনোয়ারাও ছিলেন। মোস্তাফিজুর রাত ৮টার দিকে আসেন। সেদিন ভাত খেয়ে সবাই যে যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়েন।

পরদিন (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টার দিকে বাবা এবং আমরা দুই ভাই আলোচনার জন্য এক রুমে বসি। একপর্যায়ে বাবা আবার বলেতোরা আমার সন্তান না। তখন আমাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। বাবা আমাকে থাপ্পড় মারে। তখন আমার মাথা গরম হয়ে যায়। সহ্য করতে না পেরে বাবার গলা টিপে ধরি। এতেই বাবা মারা যায়।

মোস্তাফিজুর জানান, হাসান মারা গেছেন বুঝতে পেরে খাটের নিচে থাকা মুড়ির প্লাস্টিকের বস্তা বের করে সেটার মধ্যে ঢুকিয়ে রুমের এক কোণায় রেখে দরজায় তালা দিয়ে দুই ভাই বেরিয়ে যান। বিকেল তিনটার দিকে ছোট বোনের জামাইকে ডেকে এনে তার সঙ্গে ছেনোয়ারাকে বাঁশখালীতে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে রুমের দরজা খুলে সফিকুর বাবার লাশভর্তি বস্তা নিজের রুমে নিয়ে যান। তখন সফিকুরের স্ত্রী আনারকলি বিষয়টা জানতে পারেন এবং এ নিয়ে দুই ভাইকে দোষারোপ করতে থাকেন।

তিনি বলেন, দুই ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই লাশ টুকরো টুকরো করে দূরে নিয়ে ফেলে দেব। ছোট ভাই পলিথিন ও স্কচটেপ কিনে আনার পর ঘরে থাকা ধামা দিয়ে হাতপা কেটে আট টুকরো করে পলিথিনে মুড়িয়ে টেপ পেঁচিয়ে প্লাস্টিকের চালের বস্তায় ঢুকাই। শরীর আরেক বস্তায় ঢুকাই। মাথা একটি শপিংব্যাগে ভরে রুমের এক কোণায় রেখে দিই। রাত ৩টার সময় আমার ছোট ভাই একজন মদ্যপ লোককে বাইরে থেকে ডেকে এনে তাকে দিয়ে শরীরের অংশটি খালে ফেলে দেয়।

মোস্তাফিজুর আরও বলেন, হাতপায়ের টুকরোগুলো ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর স্যুটকেসে ভরে রাখি। পরদিন (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে আনারকলি ও আমি মিলে প্রথমে রিকশায় এবং পরে ক্রসিং মোড় থেকে অটোরিকশায় করে পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাটে গিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিই। ছোট ভাই মাথা ফেলার দায়িত্ব নিয়েছিল।

তিনি বলেন, আমি বাড়ি ফিরে যাই। তখন মা জিজ্ঞেস করেতোর বাবা কই? আমি বলিমেরে ফেলেছি। মা কপালে হাত দিয়ে কান্না করতে থাকে। ছোট ভাইকে বাড়ি যেতে বললেও সে মোবাইল বন্ধ করে রাখায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন (২২ সেপ্টেম্বর) মাগরিবের নামাজের পর ইউপি মেম্বার পুলিশ নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। পুলিশ আমাকে বাবা কোথায় জিজ্ঞাসা করে। আমি বলিজাহাজে। যোগাযোগ আছে কি না জানতে চায়। পরদিন আমার নানার বাড়ি থেকে আমাকে ও মাকে পুলিশ নিয়ে আসে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহত্যার পর মরদেহ লুকিয়ে রাখা হয় কচুরিপানায়
পরবর্তী নিবন্ধসম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখছে কাগতিয়া দরবার