আগামীকাল বিশ্ব হার্ট দিবস। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চট্টগ্রামে হৃদরোগীর হার অনেক বেশি। এরজন্য চট্টগ্রামের মানুষের খাদ্যাভ্যাসকেই প্রধানত দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষ ঐতিহ্যগত ভোজনরসিক। খাবারে অতিরিক্ত তেলের ব্যবহার ও ভাজাপোড়া খাবার হৃদরোগের অন্যতম কারণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের হৃদরোগের প্রকোপ বেশি হলেও এখানে গড়ে উঠেনি হৃদরোগের কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল। বেসরকারি বেশ কিছু হাসপাতালের হৃদরোগের চিকিৎসা চালু থাকলেও খরচের কারণে গরীব ও অসহায় রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিতে পারেন না। এসব রোগীদের একমাত্র ঠিকানা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ। সেখানেও প্রায় সময় ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ তিনগুণ রোগীর ভর্তি থাকে। ফলে প্রায় সময় হৃদরোগ বিভাগের চিকিৎসকদের রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়। এছাড়া চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের দুটি ক্যাথ ল্যাবের মধ্যে একটি গত প্রায় গত দুই বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ফলে একটি মেশিন দিয়ে রোগীদের এনজিওগ্রাম ও হার্টে রিং লাগানোসহ যাবতীয় কাজ চালাতে হচ্ছে। এই মেশিনটি নষ্ট হয়ে গেলে রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন বলছেন চিকিৎসকরা।
চমেক হাসপাতাল হৃদরোগ বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে চট্টগ্রাম মহানগর, বিভিন্ন উপজেলা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কঙবাজার ছাড়াও ফেনী, কুমিল্লার, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও বি. বাড়িয়ার একাংশের বিশাল জনগোষ্ঠী চিকিৎসা নিতে আসে। প্রায় ৪ কোটি মানুষের ভরসাস্থল হৃদরোগ বিভাগ। কিন্তু সে তুলনায় হৃদরোগ বিভাগের সুযোগ সুবিধা সেভাবে বাড়েনি। এখনো বিশাল সংখ্যক রোগীকে ফ্লোরে চিকিৎসা নিতে হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেলের হৃদরোগ বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে রোগীরা আরো বেশি উপকৃত হবেন। প্রাইভেট হাসপাতালে একজন রোগী যে চিকিৎসা পেয়ে থাকেন, সেই চিকিৎসা আার্থিকমূল্য হিসেব করলে চমেক হাসপাতালে তার খরচ পড়ে পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ক্ষেত্রবিশেষে আরো কম।
চমেক হাসপাতাল হৃদরোগ বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. রিজোয়ান রেহান বলেন, হৃদরোগ থেকে রক্ষা পেতে প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। ধুমপান, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল, মেদ বাহুল্য প্রতিরোধ ও চিকিৎসার মাধ্যমে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ সম্ভব।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতাল হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশীষ দে দৈনিক আজাদীকে বলেন, চমেক হৃদরোগ বিভাগের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তবে হৃদরোগীর হার যেহেতু বাড়ছে, তাই সক্ষমতা আরো বাড়ানো উচিত। আমাদের দুটি ক্যাথল্যাবের মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এ বিষয়ে আমরা চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি এবং মৌখিকভাবে একাধিকবার জানিয়েছি। আমাদের এখন একটি ক্যাথল্যাব মেশিন দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। এ মেশিনটিতে মাঝে মাঝে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। আমাদেরকে মেশিনের ইঞ্জিনিয়ার জানিয়েছেন–এই মেশিনের যা সেল্ফ টাইম সে পরিমাণ কাজ ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। তাই এই মেশিন নষ্ট হলে কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।
জানা গেছে, ক্যাথল্যাব বা কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেনশনের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি, ভালব (কপাটিকা), ধমনির পরিস্থিতি জানতে এবং হৃদযন্ত্রের রক্তের চাপ বুঝতে রোগীকে ক্যাথ ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। ত্রুটি ধরা পড়লে প্রয়োজনমতো রক্তনালিতে স্টেন্ট বা রিং পরানো, পেসমেকার বসানো, সংকুচিত ভালবকে ফোলানোসহ অস্ত্রোপচার করা হয়।
চমেক হাসপাতাল হৃদরোগ বিভাগের ক্যাথল্যাব সিনিয়র স্টাফ নার্স খোকন কান্তি বিশ্বাস বলেন, জাপানের শিমার্জু ব্র্যান্ডের এনজিওগ্রাম মেশিনটি চট্টগ্রাম মেডিকেলের হৃদ্রোগ বিভাগে স্থাপন করা হয় ২০১৬ সালে। ২০২১ সালের শেষের দিকে এঙ–রে টিউব নষ্ট হওয়ায় পড়ে আছে।
অপরদিকে চট্টগ্রামবাসীর হৃদরোগের চিকিৎসার কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। গত বছরের ২৫ নভেম্বর নগরীর ও আর নিজাম রোডে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নির্ধারিত জঙ্গল সলিমপুরস্থ প্রায় পাঁচ একর জায়গায় চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশনের নিজস্ব হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিসিইউ, ক্যাথল্যব, আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটারসহ ৫০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ আধুনিক হৃদরোগ হাসপাতাল গড়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যা পরবর্তীতে তা হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রূপ নেবে। নিজস্ব জায়গায় নির্মাণ কাজ শুরু হলে প্রাইভেট–পাবলিক–পাটনারশিপের (পিপিপি) আওতায় ৬০:৪০ অনুপাতে সরকারি সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনুদানে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম চলছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ বলেন, সামর্থ্যবান হৃদরোগীদের কেউ কেউ চট্টগ্রামের বাইরে রাজধানী ঢাকা, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কিংবা অন্যান্য উন্নত দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তবে হৃদরোগে আক্রান্ত বিশাল সংখ্যক রোগীর তুলনায় এই সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। আবার হার্ট অ্যাটাক ও হৃদরোগের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিতে হয়। এখানে কালক্ষেপণে মৃত্যু ডেকে আনে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের হৃদরোগী চট্টগ্রামের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ সম্ভব নয়। তাই চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশনকে যত দ্রুত আধুনিক হৃদরোগের হাসপাতালে রূপ দেয়া হবে, তত দ্রুত চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবে।