চট্টগ্রাম অঞ্চল পাহাড়, নদী ও সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রকৃতির সবুজ শ্যামল ছায়ায় ও মায়ায় এই অঞ্চলের জনপদ সবসসময় প্রশান্তির মাঝে বিরাজমান। আর এর কারণেই এই এলাকাটি লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। প্রকৃতির অকৃপণ দানে এই অঞ্চলের মানুষের মন– মানসিকতা সৃজনশীল। প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষের যেমন রয়েছে সামাজিক রীতি– নীতি ও শৃঙ্খলাবোধ তেমনি এই অঞ্চলের মানুষেরও রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নিজস্ব লোকজ সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের লোক সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যের অংশ হিসেবে রয়েছে কিছু নিজস্ব প্রবাদ– প্রবচন। যা এই জনপদের ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ চট্টগ্রামের সংস্কৃতির ধারাকে করেছে ঐতিহ্যমণ্ডিত। প্রকৃতপক্ষে প্রবাদ– প্রবচন যেকোনো অঞ্চলের সামাজিক শৃঙ্খলা ও জীবনধারাকে উন্নত করে একটি নির্দিষ্ট রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে সহায়তা করে। যা চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়।
জনগণের মুখে মুখে, শুনে আর লোককথা ও লোকগাথা থেকেই প্রবাদ–প্রবচনগুলি সংগৃহীত হয়ে থাকে। প্রবাদ– প্রবচনের মূল শক্তি ও বিশেষত্ব হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার ও ধারণ করা। চট্টগ্রামের প্রবাদ–প্রবচনগুলি আঞ্চলিকতাকে ছাপিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। যদিও চট্টগ্রামের ভাষার জন্য এই অঞ্চলের প্রবাদ–প্রবচনগুলি অন্য অঞ্চলের মানুষের নিকট অনেকটা দুর্বোধ্য তথাপি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যের গুণে এগুলি প্রমিত বাংলার সংযোজনে দেশের ও অন্য এলাকার বাংলা ভাষী মানুষের নিকট সমাদৃত হয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয়, এই এলাকার বিভিন্ন ধর্মীয় সমপ্রদায়ের মানুষ ও তাদের আর্থ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন এতটাই দৃঢ় যে, ভাষার দুর্বোধ্যতাকে ছিন্ন করে এই প্রবাদ প্রবচনগুলি সর্বজন গৃহিত হয়ে আজ বাংলা ভাষার সম্পেদে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রবাদ–প্রবচনগুলি আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত হলেও সেগুলো অনেক মজার এবং বেশ অর্থবহ।
যেমন– ১) অক্কল তেলইনর বঅরফাতা। অনুবাদ –সকল পাতিলের ধনে পাতা। মর্মার্থ—যাকে দিয়ে সব কাজই হয়। ২) অইনত্তোবারে আইল্লা গরম। আনুবাদ–আগুনের থেকেও পাতিল গরম। মর্মার্থ–মূল ব্যক্তির চেয়ে যদি তার সহকারী অত্যাধিক মত প্রকাশের চেষ্টা করে। ৩)অক্কর দান ফক্কর যা। অনুবাদ–পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তে যায়। মর্মার্থ—অসৎ উপায়ে প্রাপ্ত সুবিধা অসৎ পথেই শেষ হয়। কোনো কাজে লাগে না। নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি প্রবাদ বাক্য। ৪) আইট্টে আইট্টে নলা, গাইতে গাইতে গলা। অনুবাদ– হাঁটতে হাঁটতে পা, গাইতে গাইতে গলা। মর্মার্থ–অনুশীলন এর মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা আসতে পারে। এই প্রবাদটি একদিকে পারিবারিক ও অন্যদিকে সামাজিক শিক্ষা দেয়। ৫)অতি চালাকর গলাত দরি অনুবাদ– অতি চালাকের গলায় দঁড়ি। মর্মার্থ– অধিক চালাকিতে বিপদের সম্ভাবনা। ৬) আদা ফচিলেও ঝাঁঝ থাহে। অনুবাদ – আদা পচলেও ঝাঁঝ থাকে। মর্মার্থ– মূল্যবান জিনিস পুরাটা নষ্ট হয়ে গেলেও তার কিছু বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট থাকে। ৭) ইঁতি নাই ভিঁডি (বাস্তুভিটা) নাই চৈধরীর পুত। অনুবাদ– ঘর নাই, বাড়ি নাই, চৌধুরীর সন্তান। মর্মার্থ–অহংকার অর্থাৎ ফুটানি বোঝাতে প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়। এটা একটা নৈতিক শিক্ষার প্রবাদ। ৮)ওস্তাদের মাইর ফোয়াইত্তা। অনুবাদ–ওস্তাদের মাইর ভোর রাতে। মর্মার্থ– ওস্তাদ মানুষ শেষ বেলাতে এসে নিজের কারিশমা দেখায়। ৯)কিলরে ভুতে ডরায়। অনুবাদ –কিলকে ভুতেও ভয় পায়। মর্মার্থ– শারীরিক শাস্তিকে সবাই ভয় পায়। ১০) কেঁডা দি কেঁডা তোলন। অনুবাদ –কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। মর্মার্থ–কৌশলে শত্রু দিয়ে শত্রু দমন করা। ১১) ঘাট পার অইলে ঘাইট্টা আঁলা। অনুবাদ– ঘাট পার হয়ে গেলে ঘাটের মাঝি শালা। মর্মার্থ— উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেলে উপকারী লোকটাও দুর্জন হয়। ১২) কলি হাইল্যার ফোয়া মাডিত পইরলে লোয়া। অনুবাদ – বর্তমান কালের ছেল মাটিতে পড়লেই অর্থাৎ জন্মগ্রহণের সাথে সাথে লোহা। মর্মার্থ– বর্তমান যুগের তরুণদের শক্তি ও সামর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৩) ছ্যাপ গিলিলে ফানির তিরাশ ন মরে। অনুবাদ – ছ্যাপ গিললে পানির তৃষ্ণা মরে না। মর্মার্থ– একই রকম হলেও এক বস্তু দিয়ে অন্য বস্তুর অভাব পূরণ হয় না। ১৪) জাতে জাত টানে, কিয়ারা গাত টানে। অনুবাদ – জাতে জাত টানে, কাঁকড়া গর্ত টানে। মর্মার্থ– মানুষ স্বজনপ্রীতি করবেই, কাঁকড়া যেমন বিপদ দেখলে গর্তে দৌঁড়ায় মানুষও বিপদে নিজের জাতের কাছেই দৌঁড়ে যায়। ১৫) থানার ঢাহদি হানও ন আডে। অনুবাদ – থানার পাশ দিয়ে কানাও হাঁটে না। মর্মার্থ– থানা পুলিশের কাছ থেকে অসাবধানীও সাবধান হয়। ১৬) ধান্না মরিচর ঝাল বেশি। অনুবাদ – ধানি মরিচের ঝাল বেশি। মর্মার্থ– ছোট জিনিসের শক্তি বেশি। ছোট বলে কাউকে অবহেলা করা উচিত না। এটাও নৈতিক শিক্ষা। ১৭) হন্ডে আগরতলা হন্ডে ছইর তলা। অনুবাদ– কোথায় আগরতলা, কোথায় চকির (খাট) তলা। মর্মার্থ– যে কোনো অসমান দুটো বিষয়কে সমতুল্য ভাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়। ১৮) যদি হয় সুজন এক ঘরঅত নজন, যদি হয় কুজন ন ঘরঅত নজন। অনুবাদ— যদি হয় সুজন এক ঘরে নয়জন। যদি হয় সুজন নয় ঘরে নয়জন। মর্মার্থ– সৎ লোক একত্রে বাস করতে পারে, অসৎ লোক পারে না। ১৯) যারে দেইত ন ফারে তার চলন বেঁয়া / বেহা। অনুবাদ– যাকে দেখতে পারে না তার চলন বাঁকা। মর্মার্থ— অপছন্দনীয় লোকের সবকিছু খারাপ মনে হয়। ২০)ভালার তারিফ হালায়ও গরে। অনুবাদ –ভালোর তারিফ শালাও করে। মর্মার্থ— যে ভালো মানুষ তাার গুণগাব সবাই করপ এমনকি খারাপ মানুষও করে। এরকম হাজারো প্রবাদ– প্রচলন সংকলিত হলেও আরো অনেকগুলি লোকমুখে প্রচলিত আছে। ড.মাহাবুবুল হক বলেন-‘চট্টগ্রামের কোনো কোনো প্রবাদ– প্রবচনে বাংলাদেশের অন্যত্র প্রচলিত প্রবাদ – প্রবচনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়’। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিশিষ্ট লোক সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী (১৯৬২–১৯৬৫) কাল পর্বে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে ৪৪৮ টি প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহ করেন। এগুলো এখনো প্রকাশের অপেক্ষায় (লোক সংস্কৃতি চর্চা– ড. মাহবুবুল হক)
চট্টগ্রামে প্রবাদ প্রবচনের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিকে আমরা জানতে পারি। বিভিন্ন প্রবাদের মাধ্যমে চট্টগ্রামের মানুষের নিজস্ব খাবার, পোশাক, চলন– বলন তাৎক্ষণিক নানা ঘটনা ও সংস্কৃতির সাথে এগুলির মিল পাওয়া যায়। যেমন এই অঞ্চলের মানুষ সমুদ্র অঞ্চলের হওয়ায় তারা কাঁকড়া ভালোবাসে এবং ঝাল খেতে ভালোবাসে যা প্রবাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তাই এই প্রবাদগুলোর ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ ও চর্চা অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক। স্বল্পসংখ্যক গুণী লেখক ও গবেষক এই সম্পদের সামান্য পরিমাণ বই প্রকাশ করেছেন। এটা অপ্রতুলনয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক, বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, নিজামপুর সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।