দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রাউজান এলাকার সুলতানপুর গ্রামে জন্ম মোহাম্মদ আবদুল খালেকের, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই। শিক্ষায় প্রায় সবক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাউজান আর আর এসি ইন্সটিটিউশন থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন। শুধু পাস নয় একেবারে চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং অর্জন করেন চট্টগ্রাম জেলা বৃত্তি। তখন মুসলমান ছাত্র যারা পড়তেন তাদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এরই মধ্যে একজন প্রথম বিভাগে জেলা বৃত্তি লাভ ছিল চরম বিস্ময়ের ব্যাপার। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের কারণে দেশের প্রতিটি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধের কারণে প্রতিজন ছাত্রের শিক্ষা জীবন এক বছর নষ্ট হয়ে যায়। আবদুল খালেক তাই এক বছর পর এন্ট্রান্স পাস করেন। তিনি রাউজান আরআর এসি ইন্সটিটিউশন থেকে পাস করে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজে আইএসসি শ্রেণিতে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি পুনরায় মেধার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। অংক ও পদার্থবিদ্যা ছিল তাঁর মূল বিষয়। যেহেতু তিনি জেলা বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র, সেজন্য কলেজে তাঁর কোন টিউশন ফি লাগতো না। এমনকি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর বই কেনার জন্যও টাকা দিয়েছিলেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আবদুল খালেক জেলা বৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। আইএসসি পাস করার পর তিনি কোন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নেবেন– এ নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এ সময় এগিয়ে আসেন চাচা আহমদ মিয়া চৌধুরী। চাচার পরামর্শে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। চাচার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। তিনি ভেবেছিলেন আবদুল খালেকের জ্ঞাতি ভাই আবুল হাসেম ডাক্তারি পড়ছে। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার হলে একই বাড়ি থেকে একজন ডাক্তার ও একজন ইঞ্জিনিয়ার দেশ ও দশের সেবায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে, যা এই সুলতানপুর গ্রামের সাধারণ মানুষকে একটা বিশেষ পরিচয় দেবে।
মোহাম্মদ আবদুল খালেক হলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার, যিনি নিজের উজ্জ্বল পেশা ছেড়ে লাইব্রেরি, প্রেস ও পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি তিনি ছেপেছিলেন অসীম সাহসিকতায়। বায়ান্নের ২২ ফেব্রুয়ারি রাতেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে শুরু হয়ে যায় কবিতাটি প্রকাশের কার্যক্রম। গভীর রাতে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্ত প্রায়, তখন সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী হঠাৎ হামলা শুরু করে প্রেসে। কিন্তু প্রেস কর্মচারীরা অতীব দ্রুততায় সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে ফেলে যে, তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পরও পুলিশ তার খোঁজ পায়নি। ফলে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’–র প্রকাশনার কাজ শেষ করা যায়। পরদিন তেইশে ফেব্রুয়ারি তারিখে লালদীঘি প্রতিবাদ সভায় কবিতাটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। পাক–সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেফতার করতে এলে প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী নিজ কাঁধে ছাপার দায়িত্ব তুলে নেন। তাই গ্রেফতার করা হয় প্রেস ম্যানেজার দবিরকে। অবশ্য পরে তাঁর জামিন দেয়া হয়েছিল। ভাষা ও দেশ মাতৃকার সেবায় নিবেদিত ব্যক্তিত্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পরবর্তী সময়ে আজাদী প্রকাশে ব্রত হন।
আজ থেকে ৬৪ বছর আগে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে সেই স্বপ্নের আজাদী আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এর আগে অবশ্য তিনি কোহিনূর নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। আজাদী প্রকাশের দুই বছরের মাথায় ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রামের সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে নতুন গতি সঞ্চার করতে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আজাদী দৃঢ়ভাবে পালন করে এসেছে কল্যাণমুখী, মানবব্রতী ও দেশব্রতী ভূমিকা। গরিব–দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের মুখে হাসি ফোটানো ছিল মোহাম্মদ আবদুল খালেকের আজীবনের সাধনা। বিত্ত ও চিত্ত এ দুটোকে সমন্বয় করে তিনি শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখে গেছেন। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের জ্যোতির্ময়ী চেতনা তরুণ সমাজে যতবেশি ছড়িয়ে দেয়া যাবে, সমাজে ততবেশি আলোকিত প্রজন্ম তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তিনি জীবদ্দশায় নানাভাবে সমাজকে অকাতরে বিলিয়েছেন, সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ছিলেন সৃজনশীলতায় ভাস্বর মহাপুরুষ। তাঁর বহুমুখী কর্মযজ্ঞ এই ঘুণে ধরা সমাজে আলোর পথরেখা তৈরি করতে পারে।