কানাডায় বসবাসরত ভারতের দৃষ্টিতে খালিস্থানি সন্ত্রাসী হারদীপ সিং নিজ্জরের সামপ্রতিক হত্যাকাণ্ডের পর কানাডা ভারতীয় এক কূটনীতিবিদকে এই হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন অভিযোগে সে দেশ থেকে বহিস্কার করলে ভারত–কানাডার সম্পর্ক একেবারে তলানীতে গিয়ে পৌঁছায়। ভারতও এর বদলা হিসাবে তার দেশ থেকে এক কানাডীয় কূটনীতিককে বহিস্কার করতে দেরি করেনি। কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টে হারদীপ সিংয়ের হত্যার পেছনে ভারতের হাত আছে এমন ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ রয়েছে বলে দাবি করেন। উত্তরে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক কড়া বিবৃতিতে কানাডীয় সরকারের এই দাবিকে সরাসরি প্রত্যাখান করে। দু’দেশের সম্পর্ক এমন মন্দার দিকে মোড় নেয় যে উভয়েই ‘ফ্রি ট্রেড চুক্তি’ নিয়ে যে আলোচনা চালাচ্ছিল তা স্থগিত করা হয়। আগামী মাসে অক্টোবরে ভারতে এক কানাডীয় বাণিজ্যিক প্রতিনিধি যাবার কথা ছিল। কানাডা সেটি বাতিল করে। ভিন্ন রাজনৈতিক মতালম্বী বা উগ্রপন্থীরা কানাডার মত আমেরিকা, ইউরোপের অনেক দেশে সক্রিয় রয়েছে। প্রবাসে বসবাস করে তারা স্বদেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। এদের কেউ কেউ তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে সন্ত্রাস, ভয়–ভীতি প্রদর্শন, খুন, হত্যার পথ বেছে নেয়। প্রবাসে বসে তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়, কখনো শান্তিপূর্ণভাবে, কখনো বা ভয়ভীতি, সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে। সুইজারল্যান্ডে জাতিসংঘ ভবনের সামনে বছরের গোটা সময় জুড়ে এরা প্রতিবাদের আয়োজন করে থাকে। ইউরোপ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। সে কারণে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে এখানে কোন বাধা দেয়া হয় না। তবে এই সমস্ত দেশে অনেক সময় ভিন্ন রাজনৈতিক মতালম্বী ব্যক্তি বা এক্সাইলড রাজনৈতিক নেতাকে আততায়ীর হাতে খুন হতে দেখা যায়। কখনো বিষক্রিয়ায়, কখনো লেকের ধারে পানিতে পড়ে, কখনো হোটেল কক্ষে। কোন মৃত্যুই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নয়। সে ক্ষেত্রে এই ধরনের মৃত্যুর সাথে ফেলে–আসা দেশের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়, অনেক সময় সরাসরি অভিযোগও আনা হয় সরকার বা নির্দিষ্ট রাষ্ট্র নেতার বিরুদ্ধে। এই ধরনের অভিযোগ প্রায় সময় শোনা যায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে, কখনো বা আমেরিকার শাসকদের বিরুদ্ধে।
এবার এমনতর অভিযোগ আনলেন কানাডীয় প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। প্রশ্ন– তিনি কেন সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনলেন যখন তিনি প্রকাশ্যে কোন প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেননি? এটি কি ভোট ব্যাংকের কারণে? উত্তরে এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মন্তব্য, সে দাবি উড়িয়ে দেয়া যায় না। কানাডার মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১,৫% শিখ ধর্মাবলম্বী। বছর কয়েক আগে ইশান তাহরুর ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছিলেন, ‘জাস্টিন ট্রুডোর ৩০ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রি–পরিষদের অর্ধেক হলেন মহিলা এবং ৪ জন মন্ত্রী হলেন শিখ ধর্মালম্বী, অথচ এই গোষ্ঠী ভারতের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ২% শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার হারজিত সজ্জন যিনি তিন তিনবার আফগানিস্তান মিশনে গিয়েছিলেন। বাকি তিনজন হলেন, অবকাঠামো (ইনফ্রাস্ট্রাকচার) মন্ত্রী অমরজিৎ সহি, ইনোভেশন, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ৪০ বছরের বিজনেস স্কুল অধ্যাপক নভদীপ বাইনস এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা ও ট্যুরিজম মন্ত্রী শিখ অভিবাসীর কন্যা ৩৭ বছরের বার্দিশ চাগার। এদের মধ্যে হারজিত সজ্জন ও অমরজিৎ সহির ব্যাপারে কানাডায় বসবাসরত সকল ভারতীয় খুশি নন। কেননা হারজিত সজ্জন প্রভাবশালী সংগঠন, ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই সংগঠনটির খালিস্তান আন্দোলনের জঙ্গি মৌলবাদীদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। ভারতে আশির দশকে পৃথক খালিস্তান আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করেছিল, যার পরিণতি ঘটে রক্তের বন্যার মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৪ সালে তার দুই শিখ দেহরক্ষী কর্তৃক নিহত হন। এরপর ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে বোমায় ৩২৯ যাত্রী নিহত হন। কানাডীয় পাসপোর্টধারী শিখ ইন্দ্রজিৎ সিং ২০০৩ সালে সন্ত্রাসী আক্রমণের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন এবং ১৫ বছরের জেল সাজা পান। দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাসের সাথে জড়িত কেউ কেউ বিনা বাঁধায় কানাডায় বিরাজ করছেন। পরবর্তীতে ভারতে খালিস্তান আন্দোলন নিয়ে তেমন কোন মারাত্মক ও ধংসাত্বক কর্মকান্ড দেখা না গেলেও ভারতের বাইরে কোন কোন দেশে এদের কর্মকাণ্ড চলছে। এই প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধ্যাপক শ্রুতি কপিলার মন্তব্য হলো, “আধুনিক পাঞ্জাবের রাজনীতি ‘খালিস্তান আন্দোলন’ থেকে দূরে সরে গেছে। আর স্বাধীন–রাষ্ট্র বর্তমানে বেশির ভাগ শিখের চাওয়া–পাওয়া নয় বলেও রাজনীতিবিদরা দাবি করেন।” তবে এই আন্দোলন নিয়ে কানাডার মত আরো কয়েকটি দেশে শিখদের অবস্থান ভিন্ন। বিগত কয়েক বছরে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জোরদার হচ্ছে বলে মনে হয়। যদিও বা এই ব্যাপারে সফলতা কতটুকু আসবে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভারত কোনভাবেই বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না সে নিশ্চিত।
গেল ৪ জুন কানাডার টরেন্টোর অন্টারিও এলাকায় প্রো–খালিস্তান রেডিক্যাল শিখরা অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির বা গোল্ডেন টেম্পলে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী যে শুদ্ধি–অভিযান চালিয়েছিল তার ৩৯তম বার্ষিকী উপলক্ষে এক প্যারেডের আয়োজন করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায় এক শিখ প্যারেডে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লাইফ–সাইজ পোস্টার লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। প্যারেডে ব্যানারে লেখা ছিল ‘শ্রী দরবার সাহেবে আক্রমণের প্রতিশোধ’। আগেই বলেছি খালিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে উগ্রপন্থী শিখরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতে আন্দোলন করে আসছিলো। শিখদের ধর্মীয় পবিত্র স্থান, স্বর্ণ মন্দির যা গোল্ডেন টেম্পল হিসাবে পরিচিত তাকে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আখড়া বানিয়ে তুলেছিল। উগ্রপন্থী শিখ নেতা ভিন্দ্রেনওয়ালে ও তার সশস্ত্র অনুসারীরা সেখানে আশ্রয় নেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে অভিযান চালায় ভারতের সামরিক বাহিনী এবং উৎখাত করে মন্দিরের ভেতর অবস্থানকারী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নবাদীদের। এই অভিযানে অনেকে নিহত হন, ক্ষতি হয় মন্দিরের। এই আক্রমণের প্রতিশোধ নেয় উগ্রপন্থী শিখরা। অভিযানের মাস কয়েক পর ১৯ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন তার দুই সশস্ত্র দেহরক্ষীর হাতে। গোটা ভারত জুড়ে শুরু হয় দাঙ্গা ও সামপ্রদায়িক সংঘাত। মারা যায় তিন থেকে সতের হাজার নাগরিক, যার বেশির ভাগ ছিল শিখ। তবে ভারতীয় সরকার দেশের ভেতর উগ্রপন্থী শিখদের দমাতে পারলেও ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যে ক্ষোভ জমে ছিল। আর তারই ফলশ্রুতিতে কানাডা এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে এখনো দেখা যায় প্রবাসী ভারতীয় শিখ সমপ্রদায়ের প্রতিবাদ, উস্কানিমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত এই সমস্ত সন্ত্রাসীদের কানাডা লালন পালন করছে এবং এদের বিরুদ্ধে প্রমাণাদিসহ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে ভারত দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে। সপ্তাহ কয়েক আগে জি–২০ বিশ্ব সম্মেলনে কানাডার প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নতুন দিল্লী এলে ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ব্যাপারে নতুন করে তার কাছে ভারতের গভীর উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত বলে, ‘তারা কানাডায় বিচ্ছিন্নবাদিতা প্রমোট করছে এবং ভারতীয় কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে, ডিপ্লোমেটিক স্থাপনাগুলির ক্ষতি সাধন করছে এবং কানাডায় বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকদের ভয়–ভীতি দেখাচ্ছে।’ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হারদীপ সিংকে ধরিয়ে দিতে ভারতীয় জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ ১০ লক্ষ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ভারতের জলন্ধরে এক হিন্দু পুরোহিতকে খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এছাড়া সামপ্রতিক সময়ে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ভারতীয় দূতাবাসে হামলার ঘটনায় হারদীপ সিংয়ের সম্পৃক্ততারও অভিযোগ ছিল। এই পটভূমিতে কানাডার সুরি শহরে গত ১৮ জুন একটি শিখ উপাসনালয়ের বাইরে হারদীপ সিং খুন হন। তারপর বহিস্কৃত হন ভারতীয় কূটনীতিক কানাডা থেকে, ভারত থেকে কানাডীয় কূটনীতিক। দু’দেশের সম্পর্ক পৌছুলো একেবারে তলানিতে।
এমন পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নটি বড় দেখা হয়ে দেখা দিচ্ছে তা হলো, ভারত কানাডার সম্পর্কের এই অবনতি দুই দেশের অর্থনীতির উপর কী মন্দ প্রভাব ফেলবে। কানাডা ভারতের ১৭তম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। কানাডা ২০০০ সাল থেকে ভারতে ৩.৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে ভারতে কানাডার পণ্য বাণিজ্য বেড়েছে চার বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। এর বিপরীতে কানাডায় ভারতীয় রপ্তানি ছিল ৪ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। একই সাথে কানাডা থেকে আমদানির পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। মোট ৬০০টির বেশি কানাডীয় কোম্পানি রয়েছে ভারতের বুকে, অন্যদিকে কানাডায় রয়েছে ভারতের ৩০টি কোম্পানি, যা হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে দু’দেশেই। দেশ, জনগণ তথা বিশ্বের বৃহত্তর কল্যাণের কারণে যে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হওয়া দরকার তা বলা বাহুল্য। এই লক্ষ্যে দু’দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় যত তাড়াতাড়ি ঘটবে ততই মঙ্গল।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট