টিপু সুলতান বা ফতেহ আলী সাহাব টিপু ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসনকর্তা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন। তাঁর শৌর্যবীর্যের কারণে তিনি শের–ই–মহীশূর বা মহীশূরের বাঘ নামে পরিচিত ছিলেন।
মাদ্রাজ তথা চেন্নাই শহর থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে চারপাশে পাহাড় বেষ্টিত ছোট্ট শহর ভেলোর। এই শহরেই ১৯০০ সালে গড়ে তোলা হয় সিএমসি বা ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ নামক হাসপাতাল। বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটে আসে এই হাসপাতালে। এর পাশেই রয়েছে বিয়োগান্তক ঘটনার এক মহান নায়ক টিপু সুলতানের দুর্গ বা ভেলোর ফোর্ট। যেখানে তাঁর পরিবারের রক্তের দাগ লেগে আছে। দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষজন চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি টিপু সুলতান দুর্গে এসে প্রাচীন বৃক্ষরাজির ছায়াতলে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে সময় কাটায়।
দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রদেশ তামিল নাডুর বৃহত্তম দুর্গ এটি। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসনকালে এই দুর্গ নির্মিত হয়। টিপু সুলতানের মূল প্রাসাদ বেঙ্গালুরুর মহীশূরে। সপ্তদশ শতকে সুলতানের কাছে পরাজিত হয়ে ভেলোর ফোর্ট বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শেষ রাজবংশ আরাভি দাসের হাতছাড়া হয়। মাত্র কয়েক দশক পরেই সেই দুর্গ জয় করে নেয় মারাঠা গুষ্টি। অষ্টাদশ শতকে দুর্গ দখল করে মুঘলরা। এরপর তা ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। টিপু সুলতান, পিতার ইংরেজ বিতাড়ন যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে ১৭৯৯ সালে এক যুদ্ধে প্রাণ হারান। যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হবার পর টিপুর পরিবারসহ রাজপ্রাসাদের সব সদস্যকে ইংরেজ বাহিনী বন্ধী করে নিয়ে আসে ভেলোর শহরে। শহরের উপকন্ঠে নির্মিত ঐ দুর্গে নারী, শিশুসহ তাদের সবাইকে বন্ধী করে রাখা হয়। পরবর্তিতে এখানেই তাদের হত্যা করে দুর্গের অনতিদূরেই পর্যায়ক্রমে সবাইকে সমাহিত করা হয়। প্রায় ১৩৩ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ভেলোর দুর্গ গ্রানাইট পাথর দিয়ে নির্মিত। দুর্গের চারপাশে রয়েছে লেইক সদৃশ একটি বড় জলাধার, যা দুর্গের পরিখা হিসেবে নিরাপত্তায় ব্যবহার হতো। জনশ্রুতি আছে, এই পরিখায় হাজার হাজার কুমির ছিলো। দুর্গে অবস্থিত সুড়ঙ্গ প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বীরঞ্জিপুরামে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। দুর্গের স্থাপত্য এবং শিল্পকাজের কোনও তুলনা হয় না। এই দুর্গের সবকিছুই পাথর দিয়ে বানানো। এর নির্মাণশৈলী বিস্মিত করার মতো। সব মিলিয়ে অনন্য একটি স্থাপত্য টিপু সুলতান দুর্গ। ১৭৯৯ সালে চতুর্থ ও শেষ মহীশুর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত টিপু সুলতানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর এ পরাজয়ের পর পুরো দক্ষিণ ভারত ইংরেজদের করায়ত্ব হয়।
টিপু সুলতানের ছিলো ৪ স্ত্রী, ১৫ পুত্র, ৮ কন্যা। সবাইকে ভেলোরের এই দুর্গে হত্যা করা হয়। এখনো দুর্গের দেয়ালে উঠলে দর্শনার্থীরা অনুভব করতে পারে সেই সব বন্দী নারী পুরুষের আর্তচিৎকার। টিপু সুলতান দুর্গ দেয়ালের কোণায় কোণায় সুলতান আর সুলতানদের স্বপ্নের অপমৃত্যুর স্পষ্ট ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। তামিল নাডুর ভেলোর শহরের এই দুর্গ সেখানকার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে।