সময়ের কথন : আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!
“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”–বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিমের একটি বহুল পরিচিত গানের কলি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেমন নজরুলের উদ্দেশ্যে “আজি হতে শত বর্ষ পরে’– উৎসর্গ করেছিলেন–শাহ আবদুল করিম বাংলাদেশের আরেক গীতশিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে কোন গান লিখেননি। তারপরও নকুল বিশ্বাস শাহ আবদুল করিমের বিপরীতে গাইলেন “আগে কি কষ্টে দিন কাটাইতাম”।
প্রত্যেকের ভাবনাকে সম্মান জানানো দরকার যতক্ষণ না তা বিকৃত মানসিকতা প্রকাশ করে। তথ্য–প্রযুক্তি জীবনকে সহজতর করছে। কিন্তু হিসেব নিকেশে নেগেটিভ বার্তাও আসছে। পাশ্চাত্যে ঢালাও তথ্য–প্রযুক্তির ব্যবহারের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে গাদা গাদা বই–পুস্তকে বাজার সয়লাব।
আমাদের ছোটকাল কেটেছে প্রকৃতির উজ্জ্্বল আনন্দ–ঘন পরিবেশে। ষড়ঋতু যেমনভাবে মাসচক্রে পরিবর্তিত হয় তেমনি বাচ্চাদের আনন্দও হতো ঋতু নির্ভর। মা–বাবার সান্নিধ্য জমিদারের তনয় রবীন্দ্রনাথ যেমন পেতেন না আমরাও সারাদিন পাড়ার ছেলেদের সাথে ‘টো–টো’ করেই অধিকাংশ সময় কাটাতাম।
বর্ষাকালে বৃষ্টি ভেজা, নৌকা করে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ বর্তমান কোন নৌ–বিহারেই মেলা ভার। বন্যার পানি কমলে রাতের পড়া ও খাবার পরে পাড়ার চাচাদের সাম্পানে জোৎস্না রাতের কিছুটা আনন্দ–বিহার ও ভেজা রাতের বাতাসের পেলব আনন্দ একটা সহজাত আনন্দ। শুধু শাহ আবদুল করিম না–যে কোন আমাদের বয়সী মানুষ গাইবে “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” বর্ষার পানি কমলে দুটো আনন্দ বাচ্চাদের। একটা হল কাদায় খেলায়, আরেকটা হচ্ছে মাছ ধরার মহোৎসব। কাদায় খেলে সবাই পুকুরে নিজে নিজেই ‘সাফ’ করে ফেলত। কিন্তু আমার মা আমাকে এক থাপ্পড় দিত আর সাবান দিয়ে দুতিন বার মেখে পরিষ্কার করতেন। যতক্ষণ কাদা–সাবানের কারবার চলত ততক্ষণ থাপ্পড়–মারও চলত। সাফাই শেষে মা অদ্ভুত এক শাস্তির ভয় দেখাত। এই শাস্তির কথা মনে হলে এই বয়সেও হৃদকম্পন শুরু হয়।
আমার মনে হয় আমাদের ছোটকালের ৬০–৭০ বছর আগে শরৎবাবু তিন ‘শ্রীকান্ত’ চরিত্র শেষ করলেও ৬০ বছর পরেও গ্রাম–বাংলার ঘরে ঘরে অজস্র ‘শ্রীকান্তের’ পদচারণা আমাদের বাল্যকালেও ছিল। আমার আম্মার শাস্তির হুমকিটা ছিল এরকম– আরেকবার যদি গায়ে কাদা লাগাস, তোর গা এঁকে এঁকে বাটা মরিচ লাগায়ে আমি যদি লাল পিপড়া (খড়–পিপড়া) না লাগাই তবে আমি বাপের বেটি না। এই মহাশাস্তির কথা শুনেই আমার ‘শ্রীকান্তপনা’ উধাও হয়ে যেত। এটা কল্পনা ও আমার কাছে ভয়াবহ মনে হত। গা চাকু দিয়ে আঁকা, বাটা মরিচ ছিটানো, তারপর বড় লাল পিপড়া লাগানো– এটা ফাঁসির রশির মত এক ভয়াবহ ব্যাপার। আবার কোন কোন মা সত্যিই বাচ্চাকে রশি দিয়ে খাট–পালং এর খুটির সাথে বেঁধে রাখতেন যেন বর্ষায় বাইরে না যায়।
বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল আছে যারা ১৯৮০ সালের আগে বাজার থেকে মাছ কিনে খায়নি। খাল–বিলে বর্ষা পরবর্তী, ভাদ্র–আশ্বিন মাসে মাছের ‘জো’ (Plenty) পড়ত। হাত দিলেই পানিতে মাছ। আমাদের এক লোক লুংগী ভরে মাছ ধরে ন্যাংটা বাড়ি ফিরেছিল। অতি ফলনের জন্য রাসায়নিক সার এর ব্যবহারের ফলে পোকা মাকড় ব্যাঙ এর সাথে মাছও বিলুপ্ত। হায়রে সেদিন ইংরাজীতে বলে Those days are gone বাংলায় তরজমা নাকি–সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই।
১লা বৈশাখ সব অর্থেই সার্বজনীন উৎসব ছিল গ্রামে। সারা দিন পাড়ায় পাড়ায় মেলা, বলী খেলা হত। মেলায় মাটির তৈরী হরেক রকমের জিনিস বিক্রি হত। নাগরদোলা, আইসক্রীম, বরফের সরবত গ্রামীণ ছেলেমেয়েদের জন্য অনন্য দিন বৈ কি!
বলীখেলা, গরুর লড়াই, কবিগান কাওয়ালী, যাত্রা অভিনয়, ঐতিহাসিক নাটক গ্রামীণ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ছিল। মানুষের উপস্থিতি হত স্বতঃস্ফূর্ত। আমাদের এলাকার বলী খেলায় চেয়ারম্যান, এমপি প্রধান অতিথি থাকতেন না, কাদিরা বলী নামে শতবর্ষী এক বলীকে চেয়ারে বসানো হত। উনি বলী খেলা দেখতেন ও বিজয়ীদের মেডেল দিতেন।
গ্রামে দক্ষ অভিনেতারা মাস দুই মাসের প্রস্তুতিতে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। খেলার মাঠে শত শত মানুষ নাটক, কবিগান উপভোগ করত। আমার এক ইংরাজী শিক্ষক সুরেশ বাবু, বেশ লম্বা, ওয়ার্ডসওয়ার্থের ড্যাফোডিল কবিতা ইংরাজীতেই বোঝাতেন। সুরেশ বাবু সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মোহন লালের অভিয়ন করতেন। স্কুলের ছেলেরা স্যারকে নিয়ে ছড়া গেথেছিল–
‘বাংলা–বিহার–উড়িষ্যা
হাটু ভাংগা সুরেইশ্যা,
মাইজভান্ডার দরবার শরীফ নিকটস্থ এলাকা হওয়ায় কাওয়ালীর আসর হত এলাকায়। তখন বাজার মাত করতেন আবু কাওয়াল। মূল সংগীত শুরুর আগে হারমোনিয়ামে তালই দিত দশ–পনর মিনিট। বিষয়বস্তু অতি আধ্যাত্মিক মনে হত। কাউয়ালের সহযোগীরা তালি দিলে দর্শকরাও চিল্লাচিল্লী করত। রাত ১টা–২টায় কাওয়ালী শেষ হত। দর্শক কি বুঝত আমি এখনো ভাবি। আবু কাউয়ালেল যে দুটো লাইন আমার মনে আছে– তা হল–
“ইয়া খাজা মে আয়া বহু দূরসে
মেরে কিস্তি ভর দে তুজে
মোহাম্মদ কি নুর সে।”
যেহেতু কারেন্ট–ফ্যান এর বালাই ছিল না। বেশী গরম পড়লে স্কুল শুরু হত সকালে। এটাকে বলা হত ‘মর্নিং স্কুল’, মর্নিং স্কুল সকাল ৭ টায় শুরু হয়ে ১১ টায় শেষ হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল কোমলমতি বালকরা যাতে রৌদ্র–তপ্ত গরম থেকে রক্ষা পেয়ে ঘরে অবস্থান করে। কিন্তু বাস্তবে মর্নিং স্কুল টাইমে ঘটে উল্টোটা বাড়ি ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে সব ছেলে গ্রীষ্মের দাবদাহে আম গাছ তলে ঘুরে বেড়ায়। চাঁদা তুলে ছোরা কিনা হত কাঁচা আম–লবণ–মরিচ এর জন্য। আবার কিছু সেয়ানা ছাত্র চাঁদা তুলে ক্যাপেস্টেন সিগারেটও খেত। এখন মনে হয় শরৎচন্দ্রের চোখে ধরা পড়ে এক শ্রীকান্ত। কিন্তু লক্ষ শ্রীকান্ত ঘরে ঘরে।
এরকম নেহায়েৎ উচ্ছল প্রাকৃতিক পরিবেশে গ্রামে বেড়ে ওঠা তরুণ তরুণী বয়স পরিক্রমায় শহরে এসে ভাল কলেজে ভর্তি হত। তারাই ষাটের দশকের ছাত্র নেতা ও পরবর্তীতে বড় বড় চাকুরীজীবী। এরাই স্বাধীনতা পূর্ব নৈতিক আদর্শকে জীবনের সাথে একাত্ম করে নিয়েছিল। এটা ছিল জীবনের স্লো মোশান, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ ভ্রাতৃত্বের ও অসাম্প্রদায়িক এক দেশের ছবি। পরবর্তীতে শুরু হয় মানি মেকিং এট এনি কষ্ট–যে কোনভাবে টাকা বানানোর যুগ।
করি যে ভাবনা / সেই দিন আর পাব না / দিন হইতে দিন / আসে যে কঠিন / করিম দীনহীন (গরীব) কোন পথে যাইতাম। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক