চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চা

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত | সোমবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রভাষক প্রথাবিরোধী লেখক ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ ‘বলাকা’ (সেপ্টেম্বর ২০০৩) পত্রিকায় শরীফা বুলবুলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চট্টগ্রামে থাকলে আমি হয়তো এমন প্রখ্যাত লেখক হতাম, যার কোনো বই বেরোয়নি’। সম্প্রতি বিষয়টিকে আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন বাংলা একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি রাশেদ রউফ। গত ৪ঠা জুলাই ২০২৩ তারিখে ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ তাঁর ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ কলামে লেখেন, ‘আমরা যারা চট্টগ্রামে বসে সৃজনশীল নানা মাধ্যমে কাজ করি, নানা সৃজনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত আছি, আমরা জানিকতো কঠিন ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ঢাকা শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়, শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতিসবকিছুর প্রাণকেন্দ্রেও। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ঢাকা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। রাজধানী মানে হলো পাহাড়ের চূড়োর মতো। ওখানে একফোঁটা জল পড়লেও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর রাজধানীর বাইরের অঞ্চল মানে পাহাড়ের পাদদেশ। সেখান থেকে পাহাড়ের চূড়োয় পৌঁছা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জল পৌঁছানো দূরের কথা, ঢিল ছুঁড়েও চূড়ো পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সহজ নয়’। এই প্রতিকূলতাকে পাশকাটিয়ে কিংবা কেন্দ্রকে মোকাবেলা করেই প্রান্তের বাসিন্দাদের সাহিত্যচর্চা করতে হয়। এমন প্রেক্ষাপটে বিচার্য অধ্যাপক ও গবেষক কাঞ্চনা চক্রবর্তী বিরচিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একশত আটান্ন জন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সাহিত্যচর্চার বিবরণ নিয়ে প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর: শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চা (২০২৩) বইটি।

সাহিত্যচর্চায় রাজধানী থেকে দূরে চট্টগ্রামের তথা প্রান্তের মানুষের মনের জোর ও সাধনা যে অনেক প্রখর তার প্রমাণ মধ্যযুগেই আমরা পাই। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে বসে কবি আবদুল হাকিম প্রচণ্ড দ্রোহে লেখেন, ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। উনিশশো বাহান্নোর ভাষাআন্দোলনের সময়েও প্রথম প্রতিবাদী কবিতা লেখেন চট্টগ্রামের কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। চট্টগ্রামে বসে লেখা তাঁর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি আজ একুশের প্রথম কবিতা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যখন প্রত্যক্ষ করলেনপাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দালালেরা বুদ্ধিজীবী নিধন করে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীপ্রগতিশীল শিক্ষকদের প্রায় শেষ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয় অথচ পণ্ডিতসাহিত্যিক আবুল ফজলকে। বঙ্গবন্ধুহত্যাকাণ্ডের পর প্রথম ছোটগল্প লিখে প্রতিবাদ জানালেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সাবেক ভিসি। তাঁর বিখ্যাত সেগল্পের নাম ‘মৃতের আত্মহত্যা’। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূসও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী জোবরা গ্রামে তাঁর ‘ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি’ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামও আজীবন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে গেছেন। আমাদের আলোচ্যগ্রন্থের অন্বিষ্ট অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নয়, কেবল প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তবে গুণী শিক্ষার্থী সৃষ্টিতে অধ্যাপকদের প্রেরণাও অস্বীকার করা যায় না বলেই এ প্রসঙ্গের আলোকপাত।

চট্টগ্রাম যেমন পাহাড়সমুদ্রের সম্মিলনে গড়ে ওঠা এক নয়নাভিরাম শহর; তেমনি শহর থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যশোভা এখানকার ছাত্রশিক্ষকদের মনে কাব্যপ্রতিভার স্ফূরণ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্লাসের আগেপরে জারুলতলার আড্ডা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, পাহাড়ী ঝর্ণা, শামসুন্নাহার হলের সামনের মাঠ আর শাটল ট্রেনের দোলা এখানকার কতো বিজ্ঞানশিক্ষার্থীর মনেও ছন্দের দোলা জাগিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। কলা অনুষদের কবিসাহিত্যিক অধ্যাপকগণের সাথে আড্ডার কথাতো বলতে গেলে লম্বা কাহিনি হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হল থেকে প্রকাশিত বার্ষিকী ছাড়াও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগেআগ্রহে প্রকাশিত লিটলম্যাগ, কবিতাপত্র, দেয়ালিকা ইত্যাদিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে অনলাইন প্লাটফর্মও প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন এবং সাহিত্যসাংস্কৃতিকচর্চা কিংবা মিলনমেলা আয়োজনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যেমন ‘সিইউ ফ্রেন্ডস গু্রপ’ এর বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিলে সদস্য সংখ্যা বাইশ হাজারের অধিক। তাঁরা অনলাইনে সাপ্তাহিক কবিতাপত্র ‘ষড়জ’ প্রকাশের পাশাপাশি প্রায় একশটি করে কবিতা নিয়ে ‘খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড ২০১৯’ ও ‘খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড ২০২০’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ ছাপিয়ে প্রকাশ করেছে। এছাড়াও ‘সিইউ এলামনাই এসোসিয়েশন’সহ রয়েছে শতাধিক অনলাইন গ্রুপ। ‘বাঙলা সম্মিলন’এর মতো রয়েছে বিভিন্ন বিভাগকেন্দ্রিক গ্রুপ। প্রতি ব্যাচভিত্তিক গ্রুপের পাশাপাশি এদের আবার ঢাকাসিলেটকক্সবাজার আঞ্চলিক চ্যাপ্টারও বিদ্যমান। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনিয়ন্ত্রিত ‘ইতিহাস সমিতি’, ‘ইতিহাস পরিষদ’ কিংবা ‘ইতিহাস একাডেমি’র মতো গবেষণাপ্রকাশনা সংগঠন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠেনি। প্রান্তের প্রভূত প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই এখানকার শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চা চললেও কোনো অখণ্ড প্লাটফর্ম গড়ে ওঠেনি। সঙ্গত কারণেই প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চার কোনো সমীক্ষা আমাদের সামনে নেই। প্রাবন্ধিক কাঞ্চনা চক্রবর্তী সাহস করে সে কাজে প্রবেশ করেছেন। সেজন্য তিনি চবিয়ান সাহিত্যিকদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয় ১৮ নভেম্বর ২০১৬ তে; তবে প্রাবন্ধিক তাঁর গ্রন্থের কাল নিয়েছেন ১৯৭১২০২১, অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চা অন্বেষণে তিনি মনোযোগ দিয়েছেন। আবার এই সময়ের মধ্যেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বপর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্তরাও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেতেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন কলেজের স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রিধারীরাও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারতেন। বিভিন্ন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্তরা কখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অধ্যয়ন করেননি বিধায় এই বইয়ে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা গ্রন্থকারের একান্ত নিজস্ব। কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে তিনি তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে কাজ করতেই পারেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগেপ্রচেষ্টায় প্রণীত এমন গ্রন্থ কখনোই সম্পূর্ণ নয়, সম্ভব নয়; অভিধানধর্মী গ্রন্থে সীমাবদ্ধতা থাকবেই।

সহজ কথায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যচর্চাকারী কোনো মতেই দুশোর কমতো নয়ই হয়তো দ্বিগুণও হতে পারে। তবু গবেষক কিছু তথ্যউপাত্ত উপস্থাপন করেছেন, বিষয়টিতে সবার দৃষ্টি কেড়েছেন এখানেই প্রাবন্ধিক কাঞ্চনা চক্রবর্তীর কৃতিত্ব। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনের অভিভাবক অধ্যাপক ড. অনুপম সেনকে উৎসর্গ করা বইটির প্রথম ফ্ল্যপ পড়েই মনে হয় লেখক যথার্থই মনে করেন, এ গ্রন্থ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যচর্চায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সক্ষম হবে। সর্বোপরি, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যসংস্কৃতি চর্চার মধ্যদিয়ে সুন্দরমানবিক জীবনযাপনে এবং তাঁদের উত্তর প্রজন্মকে সংস্কৃতিবান মানুষ বিনির্মাণে বইটি প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করবেএ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। [চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর : শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চা, কাঞ্চনা চক্রবর্তী, প্রকাশক: শৈলী প্রকাশন, প্রচ্ছদ: মোমিন উদ্দীন খালেদ, প্রকাশকাল: জুলাই ২০২৩, ৬৪ পৃষ্ঠা, মূল্য ২৬০ টাকা।]

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সিইউএফ কলেজ, চট্টগ্রাম৪০০০

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের মনে কষ্ট দেয়া উচিত নয়
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষার বিকৃতি : ক্রান্তি কালের সংকটের মূল উৎস