চট্টগ্রাম বন্দরের আয়ের একটি অংশ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও বার্ষিক অনুদান চাওয়ার জন্য সিটি মেয়রকে পরামর্শ দেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সিটি মেয়রকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করার আহ্বান জানান। এক্ষেত্রে কর্পোরেশনের সাধারণ সভা বা সমন্বয় সভায় যেসব সংস্থার প্রতিনিধি আসবেন না তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানানোর পরামর্শ দেন। বলেন, জনগণের রায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকায় কর্পোরেশনের কথা সরকারি দপ্তর–অধিদপ্তর শুনতে বাধ্য।
স্থানীয় সরকার দিবস উপলক্ষে গতকাল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। থিয়েটার ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সভার সভাপতি সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সিটি কর্পোরেশন অনন্য ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সরকার থেকে কোনো অনুদান পাইনি। বন্দরের আয়ের এক পার্সেন্ট কর্পোরেশনকে দেওয়ার কথা ছিল। সেটাও আবার আইনের ফাঁকফোকরে চাপা পড়ে গেছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে এবারই প্রথম স্থানীয় সরকার দিবস পালনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এর অংশ হিসেবে চসিক তিনদিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। গতকাল সকালে বেলুন উড়িয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় চসিকের স্থানীয় সরকার দিবস উদযাপন। এরপর লালদিঘি মাঠ থেকে শোভাযাত্রা থিয়েটার ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। সেখানে ‘সেবা ও উন্নতির দক্ষ রূপকার উন্নয়নে উদ্ভাবনে স্থানীয় সরকার’ প্রতিপাদ্য শীর্ষক আলোচনা সভায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদ ও মহিউদ্দিন বাচ্চু।
বন্দর থেকে কর্পোরেশনের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত : মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, যে সময় বন্দর আইনটা প্রথম মন্ত্রিপরিষদে উঠে সে সময় ঘটনাচক্রে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কর্পোরেশনে এর আগে কাজ করে যাওয়া স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল। তখন আমি বলেছি, এখানে বিশেষ বিধান থাকার প্রয়োজন আছে। নগর উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বন্দরের আয় থেকে সরকার নির্ধারিত একটা অংশ পাবে। এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও রাজি হন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে কাজ করে যাওয়া অনেক সচিব রয়েছেন। তারাও আমি যে দাবি উত্থাপন করি সেটা গ্রহণ করেন। কিন্তু আইন প্রণয়নের সময় সেটা কোনোভাবে বাদ পড়েছে কিনা সিইউ (চসিকের প্রধান নির্বাহী) দেখবেন। বাদ পড়লেও প্রশাসনিকভাবে বন্দরের আয় থেকে একটা বরাদ্দ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পাওয়া উচিত। তাহলে কর্পোরেশনের নাগরিক সেবা দেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সিটি কর্পোরেশন সরকারের কাছে বাৎসরিক অনুদান প্রত্যশা করতেই পারে। চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে মেয়র মহোদয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাইতে পারেন। আমরা নগরের সব সংসদ সদস্য সে দাবির সাথে একমত হব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতি বছর মা ও শিশু হাসপাতালকে একটি বরাদ্দ দেয়। অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয়। তাই কর্পোরেশনও সে বরাদ্দ চাইতে পারে।
তিনি বলেন, নানা বিষয়ে নাগরিকরা যে অভিযোগগুলো করেন তা ওয়ার্ড পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে সুরাহা বা নিষ্পত্তি করার জন্য জনসম্পৃক্ততামূলক কার্যক্রম সিটি কর্পোরেশন হাতে নিতে পারে।
নওফেল বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি মডেল বটে। তবে এগিয়ে যাওয়ার দিক দিয়ে মেয়র মহোদয়কে অনুরোধ জানাব, কর্পোরেশন তার যে কাজগুলো করে সেখানে যেন আরো বেশি এফিসিয়েন্সি আনা যায়। সেজন্য কর্পোরেশনের রেভিনিউ সোর্সকে আরেকটু বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ করার জন্য মেয়রকে অনুরোধ জানাব। তবে আর্থিক সক্ষমতা বাড়লেই যে পারফরমেন্স সক্ষমতা বাড়ে তা কিন্তু না। এখানে মনিটরিং গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, শুধু ট্যাক্স রেভিনিউর ওপর নির্ভরশীল হওয়া অনেক কঠিন। কারণ ঢাকা শহরে যেভাবে মানুষের হাতে নগদ অর্থ আছে বা সার্ভিস ডিফেন্স ইকোনমি, চট্টগ্রামের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সেভাবে শক্তিশালী নয়।
সিটি গভমেন্ট ও সমন্বয় প্রসঙ্গে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন সময়ে সিটি গভমেন্টের আলোচনা হয় এবং আমার বাবাও সেটা দাবি করেছিলেন। তবে বর্তমান সিটি কর্পোরেশন আইনটা কিন্তু এক ধরনের সিটি গভমেন্টের মতো করে তৈরি করা। সেখানে সকল সংস্থার প্রতিনিধিদের থাকতে হবে এবং কর্পোরেশনের কাউন্সিলররা এক ধরনের আইনপ্রণেতার ভূমিকা পালন করবেন। মেয়র সে পার্লামেন্টের প্রধান। তবে পরিবর্তন না করে যদি সিটি গভমেন্ট লিখেও দেওয়া হয় সেটা ফাংশন করার ক্ষেত্রে যদি সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না যায় তখন কিন্তু সিটি গর্ভমেন্ট নামেই থাকবে।
তিনি বলেন, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন সিডিএ, শিক্ষাবোর্ড, বন্দর, সিএমপিসহ সব দপ্তরের প্রতিনিধি বিশেষ করে কর্তাব্যক্তিরা যেন কর্পোরেশনের সাধারণ সভায় উপস্থিত থাকেন সেটা নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। যেসব সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত হবেন না সেই সংস্থার মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন, যেন এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, জনগণ রায় দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের নেতৃবৃন্দকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাই আপনাদের কথা অবশ্য আমাদের সরকারি দপ্তর–অধিদপ্তর শুনতে বাধ্য। এখানে আইনগত আলাদা থাকতে পারে। কিন্তু কো–অর্ডিনেশনের দায়িত্বে জনপ্রতিনিধিকে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে মেয়র মহোদয় অবশই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ইতোমধ্যে। যার অনেক সুফল দেখতে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা যারা শহরে সংসদ সদস্য আছি তারা সবসময় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমাদের মধ্যে যেন কোনো সংস্থা নিজেকে আলাদা না ভাবে। প্রত্যেককে বন্ধুত্বসুলভ আচরণের মাধ্যমে এক জায়গায় আনার প্রয়োজন আছে। যখনই কারো বিষয়ে সরাসরি অভিযোগ প্রকাশ্যে করি তখন প্রাতিষ্ঠানিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আমরা চাই না এমন দূরত্ব থাকুক।
নওফেল বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে সাধারণ মানুষের কাছে নাগরিক সেবা পৌঁছানো কঠিন হয়। তাই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে প্রধানমন্ত্রী সবসময় নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় সরকারের অনন্য কাঠামো। সারা দেশে যে কাজগুলো করা হয় না তা এখানে করা হয়। নাগরিক সেবা নিশ্চিতে অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের চেয়েও সরকারি অনেক অনুদান, সহযোগিতা এবং থোক বরাদ্দ কম পাওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অনেক সেবা চট্টগ্রামের মানুষকে দিয়ে যাচ্ছেন। সেজন্য আমাদের সবার কাছ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পেতে পারে।
সাড়া পাচ্ছেন না, অভিযোগ মেয়রের : মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বন্দর নিয়ে সবাই গৌরববোধ করেন। বন্দর চট্টগ্রামে। সামান্য হোল্ডিং ট্যাক্স ছাড়া বন্দর থেকে কিছু পাই না। বন্দরের আয়ের এক পার্সেন্ট কর্পোরেশনকে দেওয়ার কথা ছিল। সেটাও আবার আইনের ফাঁকফোকরে চাপা পড়ে গেছে, দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই বিকল্প প্রস্তাব করেছি মন্ত্রণালয়ে। সেটা হলো চট্টগ্রাম বন্দরে যত কন্টেনার নামানো হয় বা বিদেশ থেকে আসে, প্রত্যেকটা কন্টেনার থেকে একটা চট্টগ্রাম উন্নয়ন চার্জ নির্ধারণ করা। বন্দর থেকে মালামাল নিয়ে যেসব ট্রাক–লরি চট্টগ্রাম শহরে চলাচল করে তাদের কাছ থেকে টোল আদায় করারও প্রস্তাব করি। চট্টগ্রাম কাস্টমসের বিল অব এন্ট্রিতে একটা চার্জ আদায় করার জন্যও বলি। মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করেছি। কিন্তু আলোর মুখ দেখি না।
মেয়র বলেন, আমরা দাবি করি। আমরা চাই, আমাদের চাওয়ার অধিকার আছে। কারণ চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ রাজস্ব দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, অতীতে হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সহনীয় করে দিয়েছি। আমাদের কর কর্মকর্তাদের আদায় করতে সুবিধা হচ্ছে। তাদের মানুষের বিরূপ মন্তব্য শুনতে হচ্ছে না। তবে চট্টগ্রামে যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলো যদি আমাদের পরিপূর্ণভাবে সহায়তা করে, ট্যাক্স যদি দিয়ে দেয়, তাহলে সাধারণ মানুষের হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর নির্ভর করতে হবে না।
তিনি বলেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কর্পোরেশনকে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের রাজস্ব আয়ের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতকেও এগিয়ে নিচ্ছি। আধুনিকায়ন করা হচ্ছে নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
নোমান আল মাহমুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মূল লক্ষ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আর এ লক্ষ্যে সরকার প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার দিবস পালন করছে। সরকার চায়, যারা সাধারণ মানুষ তাদের ভাগ্য বদলের মাধ্যমে শহরের সুযোগ–সুবিধাকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে।
মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে সরকার যে সমস্ত কার্যক্রম গ্রহণ করে তার সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উন্নত দেশ গড়তে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।
এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, আফরোজা কালাম, সমাজ কল্যাণ স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি আবদুস সালাম মাসুম, স্বাস্থ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি জহর লাল হাজারী। অনুষ্ঠানে সেরা করদাতা হিসেবে ৪ ব্যক্তি ও ৩ প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেওয়া হয়। স্মার্ট সিটি কার্যক্রমে অবদান রাখায় প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, আফরোজা কালাম, কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল ও জনসেবায় বিশেষ অবদান রাখায় মেয়রের একান্ত সচিব আবুল হাশেমকে পুরস্কৃত করা হয়।