সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি নতুন করে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, বিশ্বে সকল বয়সের মানুষের মৃত্যুর ৮ম প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। এর কারণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। একই সাথে ৫–২৯ বছর বয়সের শিশু ও তরুণদের মৃত্যুর প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। তাঁরা আরও বলেন, সড়ককে নিরাপদ করার জন্য জাতিসংঘের কৌশলপত্রে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো, সড়ক নিরাপদ করতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা, সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, রোডক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ও যান চলাচলের নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে সড়কে এখন শৃঙ্খলা নেই। প্রতিদিন মৃত্যু আছে, আছে বিশৃঙ্খলা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘সড়কে সব আগের মতই, অনিয়ম কমে না, নেই সমন্বিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, ‘নগরীর বিভিন্ন সড়কে পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই, অতীতে নেওয়া পরিকল্পনাগুলোরও বাস্তবায়ন নেই। যানবাহন ধরা হচ্ছে, মামলা, জরিমানা করা হচ্ছে, আটক করছে গাড়ি; ব্যস এটুকুই। অনিয়মটাই ঠিক আগের মতো নিয়ম হিসেবে দৃশ্যমান প্রতিটি রাস্তায়। নো পার্কিংয়ে গাড়ি পার্কিং, যানজট, মোড়ে মোড়ে এলোমেলো গাড়ির লাইন, রাস্তার মাঝে দাঁড় করিয়ে গাড়িতে যাত্রী উঠানো নামানো, লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক দেখা যাওয়া– সবই আছে আগের মতোই। মাঝেমধ্যে ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন সড়কে ঘটালেও সমন্বিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নেই কোথাও। বর্তমানে নগরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। দিন যত যাচ্ছে সমস্যা তত প্রকট হচ্ছে। যানজট ক্রমশ দুর্বিষহ করে তুলেছে জনজীবন। নষ্ট হচ্ছে মানুষের শ্রম ঘণ্টা। পুড়ছে জ্বালানি। নষ্ট জ্বালানিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড়গুলোর এক–তৃতীয়াংশই বর্তমানে গণপরিবহন, প্রাইভেট গাড়ি, সিএনজি টেক্সি, রিকশা, ভ্যান ও ভ্রাম্যমাণ হকারের দখলে থাকে। এতে সাধারণ যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে চরমভাবে বিঘ্ন ঘটছে। স্কুল ছুটির সময় অবৈধভাবে পার্কিং করে রাখা ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে যানজট অসহনীয় হয়ে ওঠে।’ এছাড়া বলা হয়েছে, ৪০টির বেশি অনুমোদনহীন রুটে অবৈধভাবে চলছে নিবন্ধনহীন কয়েক হাজার গাড়ি। সেইসঙ্গে দাঁড়িয়ে গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানামা এবং একই রুটের অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলছে। সব মিলিয়ে সড়কজুড়ে যানবাহনে এখন চরম নৈরাজ্য। এসব কারণে সড়কে যানজটের পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক–মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনগণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
দুর্ঘটনা রোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সুপারিশ অনুযায়ী দক্ষচালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করা, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, পরিবহনের মালিক–শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করা এবং এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করা, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রেল ও নৌ–পথ সংস্কার ও সমপ্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, সড়ক পরিবহন আইন–২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল অনেকটাই লাঘব করা যেতো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আসলে আমরা কোনো মতেই অনিরাপদ সড়ক কামনা করতে পারি না। প্রতিদিনের এই মৃত্যুও প্রত্যাশার মধ্যে পড়ে না। যেকোনো মূল্যে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। চালকদের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। দক্ষ ও যোগ্য চালক ছাড়া কারো হাতে লাইসেন্স তুলে দেওয়া যাবে না। গাড়ির ফিটনেসের ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না। যেকোনো মূল্যে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।