অনেক জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিতে শেষ হলো জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন। সর্বসম্মতিতে গৃহীত ও ঘোষিত হলো ‘দিল্লি–ঘোষণা’। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে বিজয়ের হাসি। অনেকে আশংকা করেছিলেন যে জি–২০ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিংপিং–এর অনুপস্থিতিতে বিশ্বের ধনী ও ক্ষমতাবান দেশগুলির এই শীর্ষ সম্মেলন হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এমন কী অনেকে এও আশাংকা করেছিলেন যে সম্মেলন– শেষে কোন চূড়ান্ত ঘোষণা হয়তো আসবে না। তাদের হতাশ করে দেখা গেল এবারের জি–২০ সভাপতি ভারত, সদস্য দেশগুলির মধ্যে কয়েকটি বিষয়কে ঘিরে বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও যুদ্ধকে নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য থাকা সত্বেও চূড়ান্ত বিবৃতিতে সই করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। সেখানেই ভারতের ‘ডিপ্লোমেটিক সাকসেস’ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে এ কথা মানতে হবে যে, ইউক্রেনের সংঘাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কিছুটা আপোষ করতে হয়েছে। অনেকটা যাতে ‘সাপও মরে লাঠিও না ভাঙের’ মত। রাশিয়ার ইউক্রেন–আগ্রাসনের সরাসরি উল্লেখ করা না হলেও এই যৌথ–বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় যে, সকল দেশের ‘আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব বা কোন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত‘। এতে রাশিয়ার নাম উল্লেখ নেই বলে স্বাভাবিক কারণে নাখোশ হয়েছে রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ইউক্রেন। অথচ যে ‘ড্রাফট’ তৈরি করা হয়েছিল তাতে রাশিয়ার নাম উল্লেখ ছিল। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যৌথ বিবৃতির সমালোচনা করে বলেন, ‘এতে গর্ব করার কিছু নেই’। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনৈক মুখপাত্র এই বলে মন্তব্য করেন, ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত ‘দ্য ওয়ার ইন ইউক্রেন’ (ইউক্রেনে যুদ্ধ) এই শব্দের পরিবর্তে হওয়া উচিত ছিল, ‘দ্য ওয়ার এগেইনস্ট ইউক্রেন’ (ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ)। তবে হতাশ হলেও তিনি ইউক্রেনের অবস্থানকে এগিয়ে নেবার ব্যাপারে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার জন্যে ইউক্রেন– মিত্র দেশগুলিকে ধন্যবাদ জানান। অন্যদিকে, যৌথ ঘোষণাপত্রকে রাশিয়া স্বাগত জানিয়ে বলে এটি ‘ভারসাম্যপূর্ণ’। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্ত বিষয়ক উপদেষ্টা জেক সুলিভান দিল্লি–ঘোষণাকে ‘উল্লেখযোগ্য মাইলফলক’ উল্লেখ করে বলেন, ‘জি–২০ সদস্যরা এক হয়ে যে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে এটি তারই প্রমাণ’। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এই যৌথ ঘোষণাকে ইউক্রেন–যুদ্ধের বিষয়ে ‘অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এই যৌথ বিবৃতি দৃঢ় ভাষা, খাদ্যমূল্য এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর যুদ্ধের প্রভাব তুলে ধরেছে’।
যে যাই বলুক না কেন, চূড়ান্ত যৌথ বিবৃতিতে কিছুটা ‘ছাড়’ দেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলনা? কেননা সম্মেলনের আগে শুরুর দিকে রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছিল তেমনতর কোন পদক্ষেপ নেয়া হলে অর্থাৎ রাশিয়াকে সরাসরি আক্রমণ করে কোন প্রস্তাব উল্লেখ করা হলে রাশিয়া তা মেনে নেবে না। এখানে উল্লেখ্য যে গেল নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে যে জি–২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে যৌথ বিবৃতিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা জানানো হয়েছিল। ‘দিল্লি ঘোষণায়’ যুদ্ধের জন্যে সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করা হয়নি বটে, তবে এর ফলে ‘বিশ্বব্যাপি খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইউক্রেন যুদ্ধের মানবিক দুর্ভোগ ও নেতিবাচক প্রভাব’ সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও জি–২০ সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ‘পরিস্থিতির ভিন্ন মতামত ও মূল্যায়ন’ –এর ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমাপ্তি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কঠোর পরিশ্রম ও আপনাদের সবার সমর্থন নিয়ে নয়া দিল্লি জি–২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন ঘোষণায় ঐকমত্যে পৌঁছেছি এবং আমি জানাচ্ছি যে এই ঘোষণা গৃহীত হলো’। যৌথ বিবৃতি গৃহীত হবার পর প্রধানমন্ত্রী মোদী জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং একই সাথে সভাপতির দায়িত্বভার ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভার হাতে তুলে দেন।
সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, জি–২০ সদস্য রাষ্ট্রের অতি ক্ষমতাবান দুটি রাষ্ট্র প্রধানের– রাশিয়ার পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি– অনুপুস্থিতি। জি–২০ সম্মেলনে পুতিন যোগ দেবেন না সেটি অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। কেননা ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে চলতি বছরের মার্চ মাসে হল্যান্ডের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি) রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি–পরোয়ানা জারি করে। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তিনি বেআইনীভাবে ইউক্রেনের শিশুদের রাশিয়াতে সরিয়ে নিয়েছেন। তবে এই আদালতের বিচারিক ক্ষমতা থাকলেও কোন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা নেই। সে ক্ষেত্রে আইসিসি যা করতে পারে তা হলো, অভিযুক্তকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সহায়তায় গ্রেপ্তার করা এবং হল্যান্ডের হেগ শহরে বিচারের জন্যে হাজির করা। এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন দেশে আয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও বৈঠক এড়িয়ে গেছেন। সে কারণেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন জি–২০ সম্মেলনে পুতিন নিজে উপস্থিত না থেকে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভকে পাঠিয়েছেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা এই বলে আশ্বাস দিয়েছেন যে, ২০২৪ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী জি–২০ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন অংশ নিলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। এই আশ্বাস সত্বেও পুতিন রাশিয়ার প্রাইভেট ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর ‘ভাগনার’ প্রধান প্রিগশিনের মত কোন ঝুঁকি নেবেন না বলে ধারণা।
জি–২০ সম্মেলনে পুতিনের উপস্থিত না থাকা অনেকটা অনুমেয় হলেও চীনের প্রেসিডেন্ট সি–র অনুপুস্থিতি অনেককে অবাক করেছে। সিএনএনের হংকং প্রতিনিধি লিখেছেন, ২০০৮ সাল থেকে এই শীর্ষ সম্মেলনের সব কটিতে চীনের শীর্ষ নেতা যোগ দিয়েছেন। এমনকী কোভিড প্যান্ডেমিক সময়েও চীন প্রেসিডেন্ট ভিডিওর মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া চীন ২০১৬ সালে যখন এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল তখন বিশ্বমঞ্চে চীন তার অবস্থান ও নেতৃত্বকে তুলে ধরার জন্যে যাবতীয় পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু সমপ্রতি দেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক মন্দা ও যুব–বেকার সমস্যার কারণে সি দলের মধ্যে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া, বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকা, ভারত ও পশ্চিমের সাথে কূটনৈতিক/রাজনৈতিক লড়াইয়ে পেরে না উঠা ইত্যাদি কারণে জি–২০ এর প্রতি চীনের আগের মোহ হয়তো কিছুটা কেটে গেছে। চীন মনে করে জি–২০ গোষ্ঠীতে আমেরিকা ও পশ্চিমের প্রভাব বেশি এবং এর এজেন্ডা অতি মাত্রায় চীন–বিরোধী। ‘চীন ভারতকে দেখে চীন–বিরোধী ক্যাম্প হিসাবে এবং সে কারণে ভারত যে একটি শীর্ষ আন্তর্জাতিক সম্মেলন করতে যাচ্ছে সেটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে না’, মন্তব্য নতুন দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক অধ্যাপক। চীন প্রেসিডেন্ট সি হয়তো চীনের স্বার্থের সাথে যায় কিংবা বিশ্বকে কীভাবে পরিচালনা করা উচিত এই ব্যাপারে চীনের নিজস্ব ‘ভিশন’ ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে খাপ খায় তেমন বহুপাক্ষিক ফোরামগুলিকে অগ্রাধিকার দিতে চাইছে। যেমন সমপ্রতি অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলন এবং আসন্ন বেল্ট এন্ড রোড ফোরাম। রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শি ইয়ানহং বলেন, ‘কয়েক বছর আগের তুলনায় জি–২০ গোষ্ঠী চীন কূটনীতির জন্যে অধিকতর জটিল ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে‘। এর কারণ হিসাবে তিনি চীনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
বলতেই হয় ভারত ও প্রধানমন্ত্রী মোদীর জন্যে জি–২০ ছিল ‘বিগ শো’। আল জাজিরার অনলাইনে পোস্ট করা এক প্রতিবেদনের হেড লাইন ছিল, ‘কূটনৈতিক বিশ্বকাপ : জি ২০ শীর্ষ সম্মেলন। এটি ৪০ বছরের মধ্যে ভারতের সব চাইতে বড় কূটনৈতিক বহিঃপ্রকাশ, লাইমলাইটে সিক্ত হচ্ছে মোদী সরকার’। বাস্তবিক তাই, সিক্ত হচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী। সেক্যুলার ভারত থেকে তিনি সরে এসেছেন তার বিরুদ্ধে এই ধরনের সমালোচনা থাকলেও তার মেয়াদে ভারত অনেক কিছু অর্জন করেছে, তা স্বীকার করতেই হবে। বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে ভারতের অবস্থানকে তিনি অনেক দৃঢ় করেছেন। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে যেখানে এখনো পর্যন্ত কোন দেশ যেতে সক্ষম হয়নি, মোদী সরকারের আমলে ভারত সেখানে পৌঁছেছে। চাঁদের বুকে আমেরিকা, রাশিয়া, চীনের পর বিশ্বে ভারত হচ্ছে চতুর্থ দেশ যে চাঁদে পৌছুলো। জাপান খুব সম্ভবত শীঘ্র এই তালিকায় পঞ্চম দেশ হিসাবে তাদের নাম লেখাবে। যুক্তরাজ্যকে পিছু রেখে ভারত বর্তমানে ৩,৫ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি সহ বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম ইকোনোমি বা অর্থনীতি হিসাবে নাম লিখিয়েছে। যুক্তরাজ্য ২,৮৩ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে এখন বিশ্বের ষষ্ঠ অর্থনীতি। এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা, তারপর ক্রমান্বয়ে চীন, জাপান ও জার্মানী। অন্যদিকে ১,৪৮৬ বিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে ভারত চীনকে ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এপ্রিল মাসে ভারত জনসংখ্যার দিক থেকে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। আগামী বছরের এপ্রিল–মে মাসের কোনো এক সময় ভারতে নির্বাচন। এখন থেকেই জোরেশোরে শুরু হবে নির্বাচনী প্রচারণা। বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী যে তার শাসনামলে সামপ্রতিক জি–২০ সম্মেলন সহ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছার সাফল্যকে ভারতীয় জনগণের কাছে তুলে ধরবেন তা বলা বাহুল্য। দেখা যাক সামনে কী হয়।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট