চট্টগ্রামে ৫ মাসে নিখোঁজ শতাধিক

বাড়ছে অপহরণ ও অপহৃতকে হত্যার ঘটনা সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান সমাজবিজ্ঞানীরা

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে অপহরণ ও অপহৃতকে হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বেড়েছে। সম্প্রতি রাউজানে মুক্তিপণ দিয়েও অপহরণের ১৪ দিন পর শিবলী সাদিক হৃদয় (১৯) নামে এক কলেজছাত্রের লাশের অংশবিশেষের খোঁজ মিলল। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসে অপহৃতকে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। দেশে গত ছয় বছর ধরে এ রকম অপহরণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। এ সময়কালে সংঘটিত অপহরণের অর্ধেকের বেশি ঘটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এদিকে, বিভিন্ন থানার ডায়েরি সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় শতাধিক নিখোঁজ হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, পাওনা আদায়ে কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে ঘটছে অপহরণ। নতুন এক শ্রেণীর অপহরণকারী চক্র গজিয়ে উঠেছে, যারা আর্থিক লোভে অপহরণ করছে। পরবর্তীতে মুক্তিপণ আদায় করে বা না করে ধরা পড়ার ভয়ে খুন করতেও দ্বিধা করছে না তারা। বর্তমান সময়ের অপহরণকারীদের নিয়ে তাই শঙ্কিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাগণও। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, পেশাদার অপহরণকারীরা দেখা যেত অর্থের লোভে অপহরণ করত এবং টাকা আদায়ের প্রয়োজনে তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখত। টাকা পেলে ফিরিয়ে দিত অপহৃতকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বেকারত্ব, মাদক, হতাশা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন কারণে অপহরণকারীর খাতায় নিত্য নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) ‘ক্রাইম ইন বাংলাদেশ : অ্যাবডাকশন/কিডন্যাপিং : অ্যান ওভারভিউ ফ্রম বিপিও’ শিরোনামের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দেশে ঘটে যাওয়া অপহরণের ঘটনার মধ্যে রাজধানী ঢাকার পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান। পরিসংখ্যান মতে, ঢাকায় অপহরণের ঘটনা ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে ৩২০টি অপহরণের ঘটনা ঘটছে।

বিপিওর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অপহরণের ঘটনায় ৩০ শতাংশ মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে। অপহরণের ঘটনা মোকাবিলা ও অপরাধীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অপহরণের ঘটনায় করা মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করারও তাগিদ দেয় সংস্থাটি।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন আজাদীকে বলেন, আবারও চট্টগ্রামে গুপ্তঘাতক ও অপহরণকারীদের হাতে নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটছে। অপরাধীরা সংঘবদ্ধভাবে অপকর্ম শুরু করেছে। তিনি বলেন, নৈতিক অবক্ষয় এবং দারিদ্র্য তাদের অপরাধী করে তুলেছে। চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতীত কর্মকাণ্ডের সুনাম রয়েছে। সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এসব ঘটনা মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। আশা করছি, প্রশাসন উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

রাউজানে মুক্তিপণ দিয়েও অপহরণের ১৪ দিন পর খণ্ডিত লাশের খোঁজ মিলল শিবলী সাদিক হৃদয় (১৯) নামের এক কলেজছাত্রের। গ্রেপ্তার অপহরণকারীদের স্বীকারোক্তিতে পাহাড়ে গর্ত থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধার করে ফিরে আসার পথে বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের পিকআপ ভাঙচুর করে এবং মূল অপহরণকারী উমচিং মারমাকে (২৬) ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে। সোমবার সকালে রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের আশরাফ শাহ মাজার রোডে এ ঘটনা ঘটে।

২৫ আগস্ট ঢাকা থেকে অপহরণের পর চট্টগ্রামে এনে নূরনবী (১৪) নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওইদিন দুপুরে নগরের পাঁচলাইশ থানার হিলভিউ আবাসিকের ১০ নম্বর সড়কের একটি বন্ধ গ্যারেজ থেকে ওই কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের দাবি, ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে নূরনবীকে অপহরণ করা হয়। পরে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা মোবাইল ফোনে একটি ভিডিও বার্তাও পাঠায়। মুক্তিপণ না পেয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

১৮ জুলাই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে অপহৃত চার বছরের এক শিশুকে চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অপহরণ ও মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় অপহৃত ওই শিশুকে নগরীর সদরঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার করেছ র‌্যাব১০। অপহরণ চক্রের ‘মূলহোতা’ শাফায়েত হোসেন ওরফে আবিরসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

৮ মে ভোরে গোলাপের দোকান মাজারগেটসংলগ্ন নির্মাণাধীন ভবন থেকে রহিম নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। রহিম হত্যায় জড়িত সন্দেহে আজম খান ও হৃদয় নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবেশী আজম খানের নেতৃত্বে গত ২৯ এপ্রিল বিকালে টাকার জন্য রহিমকে অপহরণ করা হয়।

২৯ এপ্রিল চান্দগাঁও এলাকা থেকে অপহরণের তিন দিন পর এক শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক নারীসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় জব্দ করা হয়েছে অপহরণে ব্যবহার করা একটি সিএনজি টেঙি এবং শিশুটিকে বিক্রির টাকায় কেনা একটি মোটরসাইকেল।

২৮ মার্চ নগরীর পাহাড়তলী থানার মুরগির ফার্ম আলমতারা পুকুরপাড় এলাকার একটি ডোবা থেকে ১০ বছরের শিশু আবিদা সুলতানা আয়নীর লাশ উদ্ধার করে পিবিআই। গত ২১ মার্চ তাকে অপহরণ করা হয়।

৩০ জানুয়ারি ঢাকা থেকে অপহরণের পর দুবাই পাচারের উদ্দেশ্যে সাতকানিয়ায় এনে আটকে রাখা পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া মাদ্রাসা ছাত্রীকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব৭। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক দম্পতিসহ ৩ জনকে। ২৯ জানুয়ারি দেড় বছরের এক শিশুকে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে প্রতিবেশী জুয়েল মিয়াকে (২৪) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এ সময় শিশুটিকেও উদ্ধার করা হয়। শিশুটির বাবা পিয়ার মোহাম্মদকে ফোন করে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারী। ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে নারী দিয়ে কৌশলে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়কারী চক্রের হোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৪ জানুয়ারি ফটিকছড়ির ভূজপুর থেকে অপহৃত ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব৭। এ সময় অপরহণের অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণীয় জয়ে এশিয়া কাপ শেষ করল বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধকারখানা মালিকসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা