শাইখ–উল–ইসলাম প্রফেসর ড. আল্লামা মুহাম্মদ তাহির–উল–ক্বাদরী। একজন বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক বক্তা ও গবেষক। জ্ঞান–বিজ্ঞান আক্বাইদ আমলের ওপর অন্তত ৫৫টির অধিক শাখায় তাঁর সহস্রাধিক মৌলিক তাত্ত্বিক গবেষণাগ্রন্থই প্রমাণ দেয় তিনি উঁচু মাপের একজন জ্ঞানতাপস। তাঁকে বলা চলে জ্ঞান–বিজ্ঞানের চলমান বিশ্বকোষ। তিনি বর্তমান শতাব্দীর মুজাদ্দিদ তথা ইসলামী সংস্কারক হিসেবেও সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত ও বরেণ্য। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ইসলামী জ্ঞানাগার কর্তৃক স্বীকৃত এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব তিনি। তাঁর রয়েছে বৈশ্বিক সম্মান ও স্বীকৃতি। ২০১৯ সনে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা–ওআইসি কর্তৃক শান্তি বিষয়ক মহাসম্মেলনে প্রধান বক্তা (কবুহড়ঃব ঝঢ়বধশবৎ) এবং শান্তিদূত হিসেবে তিনি সম্মাননা অর্জন করেন।
তাঁর কালজয়ী রচনা ইরফান উল কুরআন কেবল কুরআন মজিদের শাব্দিক অনুবাদ নয়, বরং কুরআনের সবচেয়ে আধুনিক, আধ্যাত্মিক, মর্মস্পর্শী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রেমময় বিশ্লেষণ এতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। ভাষার মাধুর্যতা সহজবোধ্যতা এর বড় বৈশিষ্ট্য। সাবলীলতা, ভাষার গতিশীলতা ও প্রাঞ্জলতার ছাপ এতে ফুটে ওঠে। কুরআন মজিদের মূল ভাব, আবেদন ও পয়গাম এতে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ২০২১ সনের এপ্রিল মাসে মিনহাজ পাবলিকেশন বাংলাদেশ এর তত্ত্বাবধানে ‘ইরফান উল কুরআন’ এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। হুজুর শাইখ–উল–ইসলামের সরাসরি অনুমতিক্রমে উর্দু ও ইংরেজির মূল অনুবাদ হতে সমন্বয় ও গবেষণার মাধ্যমে এটি বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর থেকেই বাংলা ভাষাভাষী সর্বস্তরের পাঠক মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। পারিভাষিক অর্থের সাথে অন্তর্নিহিত বাতেনি গূঢ় অর্থের সংযোজনে এবং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত, ইশক, তাজিমের অনন্য দলিল এ বিশুদ্ধতম বিজ্ঞানময় তরজমা গ্রন্থ। বাংলা ভাষার ইতিহাসে এটিই প্রথম অন্তর্নিহিত অর্থের সমন্বয়ে ব্যাখ্যাময় তরজমা। অনবদ্য শব্দ চয়ন, উচ্চাঙ্গের ভাষারীতি, অনন্য উপমা ও ভাষাশৈলীতে অনূদিত ইরফান উল কুরআনে পবিত্র কুরআনের অর্থ ও মর্মবাণীকে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জাহেরি তথা বাহ্যিক অর্থ এবং মারেফতি অর্থসহ এ তরজমার পঠনের মাধ্যমে ঈমানদার জনতার মাঝে ঈমানি প্রশান্তিই অনূভূত হবে এ আশা করা যায়।
কুরআন মজিদের যথার্থ ভাবানুবাদ মূর্ত হয়ে উঠেছে ইরফান উল কুরআনে। কুরআনের প্রথম আয়াত হলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। কুরআনের সব অনুবাদ গ্রন্থে এই আয়াতের যথার্থ অনুবাদ উঠে আসেনি। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রহ) তাঁর ‘কানযুল ঈমানে’ এবং বর্তমান জমানার মুজাদ্দিদ ড. আল্লামা তাহির উল ক্বাদরী রচিত ‘ইরফান উল কুরআনেই’ কেবলমাত্র বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের যথার্থ অর্থপূর্ণ অনুবাদ পরিলক্ষিত হয়। আ’লা হযরতের অনুবাদ-‘আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।’ আর ড. কাদরীর ইরফান উল কুরআনের অনুবাদ-‘আল্লাহর নামে শুরু, যিনি পরম করুণাময়, সতত অসীম দয়ালু’। লক্ষ্যণীয় যে ইমাম আ’লা হযরত এবং হুজুর শাইখ উল ইসলাম আল্লামা ড. তাহির উল ক্বাদরী ব্যতীত অন্যান্য অনুবাদক বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর অনুবাদ এভাবে করেছেন– ‘আরম্ভ করছি আল্লাহর নামে’ অথবা ‘শুরু করছি আল্লাহর নামে’ কিংবা ‘আরম্ভ আল্লাহর নাম সহকারে।’ উক্ত অনুবাদসমূহ যথার্থ নয়। কারণ তাঁরা তো ‘আরম্ভ করছি’ ক্রিয়া দ্বারাই অনুবাদ আরম্ভ করেছেন। অথচ আল্লাহ তায়ালার নাম দ্বারা আরম্ভ করা উচিত ছিল। যা কেবল আ’লা হযরত এবং ড. কাদরীর অনুবাদে বিদ্যমান। অন্যসব অনুবাদ যেন ‘বিসমিল্লায় গলদ।’ কুরআন মজিদের বেশ কিছু সূরা শুরু হয়েছে হরুফে মুকাত্্তিয়াত বা গূঢ় রহস্যপূর্ণ শব্দ দিয়ে। যেমন সূরা বাক্বারার শুরু ‘আলিফ লাম মিম্্’ শব্দ দিয়ে। ২২ পারায় ৩৬ নম্বর সূরা ইয়াসিন শুরু হয়েছে ‘ইয়াসিন’ শব্দ দিয়ে। ২৫ পারায় ৪২ নম্বর সূরা ‘শুরা’র প্রথম শব্দটি হচ্ছে ‘হা–মীম’। ২৫ পারার ৪৪ নম্বর সূরার নাম হচ্ছে সূরা ‘দুখান’। যার শুরু ‘হা–মীম’ দিয়ে। এসব অন্তর্গূঢ় শব্দের কোনো শাব্দিক অর্থ কিংবা ভাবানুবাদও কেউ করতে সক্ষম নন। কিন্তু প্রায় সব অনুবাদে ‘আলিফ লাম মিম’ ‘ইয়াসিন’ ‘হা–মীম’ ইত্যাদি শব্দগুলো কুরআন মজিদে যেভাবে আছে সেভাবেই লিখে দেওয়া হয়েছে। আর এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ও আলাদা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় ইরফান উল কুরআনে। ‘ইয়া–সীন’ লিখে ব্র্যাকেটে লেখা হয়েছে (প্রকৃত অর্থ আল্লাহ তা’আলা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামই সম্যক অবগত)। এতে এই গূঢ় রহস্যপূর্ণ শব্দগুলোর অর্থ জানার ব্যাপারে পাঠকের কৌতূহল মিটবে এ আশা করা যায়। কুরআন মজিদের অর্থ বা তরজমা করতে গিয়ে কিছু কিছু জায়গায় বা বাক্যে যে ব্র্যাকেট বা বন্ধনী ব্যবহার করা হয়েছে তাতে পাঠককুল কুরআন পাকের সঠিক মর্মবাণী ও সত্যিকার বার্তা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ইসলামের নামে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা চরম পন্থা, সন্ত্রাস–জঙ্গিবাদ তথা বৈশ্বিক টেরোরিজমের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার রয়েছেন প্রফেসর ড. আল্লামা তাহির উল ক্বাদরী। ‘ফতোয়া অন টেরোরিজম’ হচ্ছে তাঁর বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো ফতোয়া। ইসলামের বিশুদ্ধ জ্ঞাননির্ভর প্রচারণার লক্ষ্যে এবং বৈশ্বিক শান্তি সম্প্রীতির দর্শন সুফিবাদি মানবিক ইসলাম ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৮১ সনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মিনহাজ–উল–কুরআন ইন্টারন্যাশনাল। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত সুফিবাদি চেতনার ধারক এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আজ বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমান যুগের জ্ঞানকোষ এবং জ্ঞানতাপস এ মহান ব্যক্তিত্ব এবং এ মর্যাদাবান আল্লাহর ওলীর ওপর বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় ডজনেরও বেশি ইসলামী স্কলার এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। এখনো অনেক দেশে অনেক গবেষক তাঁর জীবন কর্ম অবদানের ওপর গবেষণা করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশেও তাঁর ওপর ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক আল্লামা মুহাম্মদ মুরশেদুল হক ড. তাহির উল ক্বাদরীর ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো অনেকেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। শাইখ উল ইসলাম প্রফেসর ড. আল্লামা তাহির উল ক্বাদরী কর্তৃক অনূদিত কুরআন মজিদের বিশ্ববিখ্যাত বিশুদ্ধ তরজমা ইরফান উল কুরআন ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, নরওয়েজিয়ানসহ ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে নয়টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। ২০২১ সনে মিনহাজ পাবলিকেশন বাংলাদেশ এর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত ইরফান উল কুরআনের বাংলা অনুবাদ করেছেন গবেষক ডক্টর মুহাম্মদ আবদুল বাতেন মিয়াজী এবং ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদ মোহাম্মদ নাসির। হুজুর শাইখ–উল–ইসলাম প্রফেসর ড. আল্লামা তাহির উল ক্বাদরীর কুরআন মজিদের অনুবাদগ্রন্থ ইরফান উল কুরআন যে কতটা মৌলিক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বিশুদ্ধ তরজমা কুরআন গ্রন্থ তা ৩০ পারার ৯৩তম ‘আদ্ দুহা’–এর বঙ্গানুবাদ পাঠে বিশেষভাবে প্রতীয়মান হয়। তিনি ‘ওয়াদ্ দুহা’ এর অনুবাদ করেছেন এভাবে : ‘শপথ উদীয়মান প্রভাতের (যখন সূর্য উপরে উঠে স্বীয় আলো ছড়ায়), অথবা : (হে সম্মানিত হাবীব!) শপথ উদীয়মান প্রভাতের (ন্যায় আপনার সর্বাধিক আলোকোজ্জ্বল চেহারার, যার দ্যুতি অন্ধকার রূহসমূহকে আলোকিত করেছে), অথবা : শপথ উদীয়মান প্রভাতের (ন্যায় আপনার রেসালাতের সূর্য উপরে উঠার, যার নূর গোমরাহীর অন্ধকারকে আলোয় পরিবর্তন করে দিয়েছে)। এ সূরার ৭ নং আয়াত হচ্ছে ‘ওয়া ওয়াজাদাকা দ্বোয়াল্লান ফাহাদা’। আল্লামা ড. ক্বাদরী এ আয়াতের অনুবাদ করেছেন এভাবে : ‘আর তিনি আপনাকে পেয়েছেন তাঁর ভালোবাসায় নিমগ্ন ও আত্মহারা, অতঃপর তিনি আপনাকে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করিয়েছেন। অথবা : ‘তিনি আপনাকে বিপথগামী সম্প্রদায়ের মধ্যে (পথ প্রদর্শনকারী) পেয়েছেন, অতঃপর তিনি (তাদেরকে আপনার মাধ্যমে) হেদায়াত দিয়েছেন।’ এধরনের বিশুদ্ধ যথার্থ অনুবাদ কুরআন মজিদের অন্য অনুবাদগ্রন্থগুলোতে যা সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না। আমি মনে করি, এই ইরফান উল কুরআন পাঠে ঈমানদার মানুষ ঈমানি প্রেরণা লাভ করবে। ইশ্্ক, হুব্বে মুস্তফা (দ) ও আদাবে মুস্তফাই (দ) এর বড় বৈশিষ্ট্য। এর কভার দৃষ্টিনন্দন ও মজবুত। বাঁধাই টেকসই। ভেতরের আঙ্গিক সৌষ্ঠব চার রঙা ও দৃষ্টিগ্রাহ্য। ছাপা ঝকঝকে এবং কাগজও উন্নতমানের। আমি ইরফান উল কুরআনের বহুল প্রচার এবং ব্যাপক পঠন–পাঠন কামনা করি।