জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিঝভি | শুক্রবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব ও অধিকার

আল কুরআনের আলোকে শিক্ষার অধিকার:

শিক্ষা বলতে মানুষের আচরনের কাঙ্খিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো শিক্ষা। শিক্ষা হল জ্ঞানার্জনের একটি প্রক্রিয়া। শিক্ষার আরবি শব্দ “ইলম” বহুবচনে “উলুমুন” ইলম শব্দের আভিধানিক অর্থ জ্ঞান, জানা, বুঝা, অনুধাবন করা। মহান আল্লাহর প্রথম ঐশী বানী “ইকরা” “পড়ুন” পঠন পাঠন জ্ঞানার্জন অনুশীলন ইসলামের প্রথম নির্দেশনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, পাঠ করুন, আপনার পালন কর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট পিণ্ড থেকে। পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্য শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না। (সূরা: আলাক, ৯৬:)

স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক স্থাপন ও যোগসূত্র রচনার উৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো ইলম তথা জ্ঞানার্জন করা। বর্ণিত আয়াতে মানুষের পড়া লেখা ও জ্ঞান গবেষণার সূচনাতেই আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যে শিক্ষা মানুষের অন্তরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত করেনা, স্রষ্টার নাম নিয়ে যে শিক্ষা শুরু হয় না, যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ শিক্ষক নূরনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বোচ্চ সমুন্নত মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে পারেনা তারা ডিগ্রীধারী জ্ঞানপাপী। যে শিক্ষা মহান প্রভূর তাওহীদ ও প্রিয় রাসূলের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার চেতনা সৃষ্টি করে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি অকৃত্রিম আদব তাজিম ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে পিতা মাতার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অন্তরে প্রেরণা যোগায় সমাজের নির্যাতিত নিষ্পেষিত বনী আদমের প্রতি মানবতা ও সহযোগিতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয় সেটাই প্রকৃত শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা। (ইমাম আহমদ রেযা কা নযরিয়ায়ে তালিম, পৃ: ১২১ কৃত: সৈয়দ জালাল উদ্দিন কাদেরী)

শিক্ষা সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালীর অভিমত:

ইসলামী দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (মৃ.৫০৫ হি.) ইলম তথা শিক্ষার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনাদি তাঁর বান্দা ও সৃষ্টির প্রতি তাঁর কার্যাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করাকে ইলম বলা হয়। (আল মু’জামুল ওয়াসীত, খন্ড: )

বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা প্রণেতা আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ৮৫৫ হি) এর মতে ইলম তথা শিক্ষা হলো এমন একটি অপরিহার্য গুণ, যা ভালো মন্দের পার্থক্য বিধানে মানদন্ড হিসেবে কাজ করে, যাতে অদৃশ্য বিষয়াদি অনুধাবনে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকেনা। (উমদাতুল কারী, ২য় খন্ড, পৃ: )

ইসলামে পড়া লেখার উপকরণ ব্যবহারের অধিকার:

ইসলামে লিখন দক্ষতার গুরুত্ব অপরিসীম। “কলম” লিখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সূরা আলাকসহ পবিত্র কুরআনে চার () বার “কলম” শব্দের উল্লেখ হয়েছে। কলমের সাহায্যে পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞানের লাখো লাখো গ্রন্থাবলীর পান্ডুলিপি লিপিবদ্ধ হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা লেখার মাধ্যমে জ্ঞান আবদ্ধ কর বা সংরক্ষণ কর। তিনি আরো এরশাদ করেছেন, লেখার মাধ্যমে তোমরা মুখস্থ বিদ্যাকে সংরক্ষণ করতে সাহায্য গ্রহণ কর। লেখার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডার সংরক্ষিত আছে।

কলম ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা:

কলম অর্থ কর্তন করা। লিখার কলম কে চতুর্দিক থেকে কেটে ছেঁেট তৈরী করা হয়, এ কারনেই এটি কলম নামে প্রসিদ্ধ। কলম হচ্ছে জ্ঞান ও শিক্ষার বন্দিশালা। তা দ্বারা অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের তথ্য ইতিহাস ঐতিহ্য দলীল ডুকুমেন্টস লিপিবদ্ধ হয়। সংরক্ষিত হয় প্রতীয়মান হলো জ্ঞান ও কলম পরিপূরক। এ দুটি আল্লাহর বড় নিয়ামত ও বিশেষ অবদান। কলম দ্বারা লিখিত খসড়া কপি অপবিত্র জায়গায় নিক্ষেপ করা নিষিদ্ধ। হযরত আদম আলাইহিস সালাম সর্ব প্রথম গাছের পাতায় লিখেছেন, তার পর হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরোর উপর লিখেছেন। হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম কাগজের উপর লিখেছেন, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম কাগজ আবিস্কার করেছেন। (তাফসীর রুহুল বয়ান, তাফসীর নূরুল ইরফান কৃত: হাকীমুুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (.), পারা ৩০, পৃ: ১৬৫৮)

হাদীস শরীফের আলোকে শিক্ষার অধিকার:

ইসলামই মানুষকে জাহিলায়াতের অমানিশা ও অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছে, ইসলাম হচ্ছে আলো, কুফরি হলো অন্ধকার। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা শিক্ষার্জনকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ইসলাম শিক্ষা অর্জনকে অপরিহার্য করেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। (সুনানু ইবন মাজা, হাদীস: ২২০)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, তুমি শিক্ষার্থী হও, বা শিক্ষক হও, বা শ্রোতা হও বা (জ্ঞানীদের শিক্ষকদের) ভালোবাসো। পঞ্চমটির দিকে ধাবিত হয়োনা তাহলে ধ্বংস হবে। (তাফসীর আর রাযী, খন্ড: , পৃ: ১৭)

দ্বীনি শিক্ষা মানুষকে কল্যাণমুখী করে:

সুশিক্ষিত জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে সম্মানিত নবীদের যোগ্য উত্তরসূরী আখ্যা দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্জনে ব্রত শিক্ষর্থীরা আলোকবর্তিকার ধারক। আদর্শ শিক্ষকরাই দেশ ও জাতির গৌরব, সমাজের মর্যাদাবান ব্যক্তি। যুগ যুগান্তরে তাঁরা স্মরণীয় বরনীয়। শিক্ষার সামগ্রিক সিলেবাস বা পাঠ পরিকল্পনা প্রয়োগিক ও কর্মমূখী হওয়া বাঞ্চনীয়, যাতে দ্বীনি চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে বাস্তব জীবনে অর্জিত শিক্ষা প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি পরিবার সমাজ দেশ ও জাতির উন্নতি ও কল্যাণ লাভে সমর্থ হয়। সময় ও মেধা অপচয়কারী শিক্ষা পদ্ধতি অর্থহীন। অর্থহীন শিক্ষাব্যবস্থা অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীলতা বাড়াবে। যা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। সিলেবাস প্রণয়ণে শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হওয়া চাই, যা দ্বীনি মূল্যবোধ সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রাখবে। ধর্ম বিমূখ ও নৈতিক আদর্শ বিবর্জিত কোনো বিষয় কোনো ভাবেই সিলেবাসভূক্ত হওয়া কাম্য নয়।

বিশ্ব মানবতার আদর্শ শিক্ষক:

শিক্ষকতা মহান পেশা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মহান সত্তা ও ব্যক্তিত্ব সকল প্রকার গুণাবলীর সমাহার। তিনি মানব জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অনুস্মরণীয় আদর্শ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষক হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখেছেন। নবীজি এরশাদ করেছেন, আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। (উমদাতুল কারী, খন্ড: , পৃ:৪২)

অন্যায় অবিচার, পাপাচার, ব্যাভিচার, মিথ্যাচার, শটতা কপটতায় নিমজ্জিত সমাজ ব্যবস্থার ধ্বংশস্তুপের উপর দাড়িয়ে তিনি সততা ন্যায় পরায়নতা মানবতা উদারতা ও নৈতিকতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিয়ে সুশিক্ষিত আলোকিত জনগোষ্ঠী প্রস্তুত করে ইসলামকে বিজয়ী ধর্ম হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নূর নবীজি রাহমাতুল্লীল আলামীন, তাজেদারে মদীনা, সরওয়ারে কায়েনাত, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি সমগ্র বিশ্ব মানবতাকে উন্নত চরিত্র শিক্ষাদানের জন্য আবির্ভূত হয়েছি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড: , পৃ: ৩৫)

অজ্ঞতা ও মূর্খতা দূরীকরণে নবীজির নির্দেশনা:

অশিক্ষা কুশিক্ষা আজকের মুসলিম জাতির মূল সমস্যা। মহাগ্রন্থ আল কুরআনই সকল শিক্ষার উৎস। কুরআন সুন্নাহর সঠিক চর্চা ও জ্ঞান গবেষণা যত গভীর ও সমৃদ্ধ হবে জাতি তত বেশী উপকৃত হবে। সঠিক পথের দিশা পাবে। মনগড়া ভিত্তিহীন দূর্বল দলীল প্রমাণের দ্বারস্থ হয়ে ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টি করলে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হবে। অজানা বিষয়ে সঠিক তথ্য অনুসন্ধান করে তদানুযায়ী আমল করা জ্ঞানীর পরিচায়ক। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো যদি তোমরা না জানো”। (সূরা: আন নহল ৮৫)

অসুস্থ লোকেরা যে ভাবে সুস্থতার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন তেমনিভাবে সাধারণ লোকেরা অজানা বিষয়ে সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রকৃত জ্ঞানী শিক্ষিত বিশেষজ্ঞ আলেমেদ্বীনের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই অজ্ঞতার চিকিৎসা হলো জিজ্ঞাসা করা।” (আবুদাউদ, হাদীস: ২৮৪)

শিক্ষাদানে খিয়ানত করা মারাত্মক অপরাধ:

শিক্ষাথীদের পাঠদানে শিক্ষকগন পূর্ণ মাত্রায় নিষ্ঠাবান ও আন্তরিকতাপূর্ণ হতে হবে। শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক একজন অনুকরণীয় মডেল হবেন। শিক্ষকের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে যা পড়াবেন তা যেন সঠিক ও নির্ভুল হয়। পাঠদানে মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকবে। শিক্ষাদান মহৎ পেশা একটি পবিত্র আমানত মনে করবে, এতে খিয়ানত করা হবে দোষনীয় অপরাধ। হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শিক্ষাদানে তোমরা পরস্পর উপদেশ দিবে। কেননা সম্পদের খিয়ানতের তুলনায় জ্ঞান তথা শিক্ষার খিয়ানত মারাত্নক দোষনীয়। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা এ সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে শিক্ষার গুরুত্ব ও অধিকার সর্ম্পকে সঠিক জ্ঞান অর্জনের তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণি মিয়ার সুখ-দুঃখ : প্রসঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
পরবর্তী নিবন্ধঘোড়া সমাচার