দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বুধবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, দুর্নীতি ক্যানসারের মতো কাজ করছে সর্বত্র। আমার পূর্বসূরিরা যেভাবে চেষ্টা করেছেন, সহকর্মীদের নিয়ে একইভাবে আমি চেষ্টা করব এই দুর্নীতি যাতে কমানো যায়, সে উদ্যোগ নিতে।
মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) আপিল বিভাগের এই বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এই নিয়োগ শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে কার্যকর হবে বলে জারি করা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৫ সেপ্টেম্বর। এরপর শপথ নিয়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তার স্থলাভিষিক্ত হবেন।
আইনজীবীদের নিয়ে নতুন এ প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকেরা বিচারকের কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মতো করেই। আমি শুধু একটি কথা বলব, যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বা যেসব আইনজীবী বন্ধু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তারা রাজনীতিটা করুন। কিন্তু কোর্টের মধ্যে, আদালতে তারা যেন সহনশীলতার পরিচয় দেন। তারা যেন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
বিচার বিভাগের গতিশীলতা নিয়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, চেষ্টা করব, এই বিচার বিভাগকে আরও একটু গতিশীল করা যায় কি না। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ এবং অধঃস্তন আদালতে আমাদের যেসব সহকর্মী আছেন, সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা প্রত্যেকেই যেন এই বিচার বিভাগের কাজটি, বিচারের কাজটি নিজের কাজ মনে করেন। সেটি মনে করলেই শুধু সম্ভব হবে। যে পাঁচটি মামলা আমরা নিষ্পত্তি করতে পারি, এটি নিজের কাজ মনে করে করলে পাঁচ থেকে সাতটি হবে। নিষ্পত্তির সংখ্যাটা যদি আমরা বৃদ্ধি করতে পারি, তাহলে মামলাজট অনেকাংশেই কমে যাবে। আশা করি সেটি কিছুটা হলেও সম্ভব হবে।
আস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, আস্থার ঘাটতি সর্বত্রই আছে। বিচার বিভাগের ওপর আস্থার ঘাটতি নেই, এ কথা আমি বলব না। মামলা নিষ্পত্তির হার দিনের পর দিন বাড়ছে। মানুষের যদি আস্থাই না থাকবে, মানুষ কোর্টে আসবেন কেন? আস্থা আছে বলেই মানুষ কোর্টে আসেন। আস্থা শতভাগ আছে, এ কথা আমি বলতে পারব না। আস্থা নেই, এ কথা বলতে আমি রাজি নই, আস্থা আছে। আস্থার হয়তো কিছু কমতি আছে। ধীরে ধীরে আমাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সহযোগিতা নিয়ে এই আস্থা বাড়াতে চেষ্টা করব।
আসলে দুর্নীতিকে যতই আমরা না বলি, ততই যেন আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। দুর্নীতি সবাইকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। দেশে এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতির অশুভ থাবা প্রভাব বিস্তার করেনি। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে উঁকি দিচ্ছে, চোখ পাকাচ্ছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। কেবল অভাবের তাড়নায় মানুষ দুর্নীতি করে–এটি সত্য নয়। বিত্তশালী কর্মকর্তা বা ব্যক্তি আরো অর্থ সম্পদের জন্য দুর্নীতি করে। মানুষের মধ্যে নীতি–নৈতিকতার ঘাটতি হলেই দুর্নীতি জেঁকে বসে। দুর্নীতির দুষ্টচক্র দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকার বেতনভাতা বৃদ্ধি করলেও তা না কমে বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন বা সনদে বলা হয়েছে যে, দুর্নীতি সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, গণতান্ত্রিক কাঠামো, নৈতিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারকে ক্ষুণ্ন করে এবং টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসনকে বিপন্ন করে। সুতরাং এ কনভেনশনকে দক্ষতার সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তিগত সহায়তা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বের সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যম ও সাধারণ নাগরিকরা প্রতি বছর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দিবস’ হিসেবে পালন করে।
অনেকেরই অভিযোগ, আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন তেমন কার্যকর নয়। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তবে বিশ্লেষকরা বলেন, দুদকের পক্ষে সারা দেশের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তাছাড়া সারা দেশের দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণও দুদকের কাছে নেই। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির অনুসন্ধানের জন্য ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ সৃষ্টি হলেও পরবর্তী সময়ে কমিশনের জন্য প্রণীত আইনে দুদকের অধিক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় জনবল ও অফিস বিস্তৃতি হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলেই কেবল দুদক কাজ করতে পারে।
তবু দুর্নীতিবাজদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে করে দুর্নীতি করার আগে যেন একবার ভেবে দেখে এর পরিণতি কী হতে পারে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকেও এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।