অবশেষে নগর ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আগামী সপ্তাহ থেকে আন্দরকিল্লায় বিদ্যমান ৫৮ বছরের পুরনো ছয়তলা ভবনটি ভাঙা হবে। তাই ভবনটি থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র সরিয়ে নিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এছাড়া পথচারীদের সতর্ক করে নোটিশও টাঙিয়ে দেয়া হয়। পুরাতন ভবন ভাঙা শেষে সেখানে ২০ তলা নগর ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করবে চসিক। তবে প্রথমে বেইসমেন্টসহ তিনটি ফ্লোর (অবকাঠামোগত) করা হবে। এজন্য ২৮ কোটি ২২ লাখ টাকায় ‘তাহের ব্রাদার্স’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করেছে। শীঘ্রই তাদের কার্যাদেশ দেয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ধাপে ধাপে নিজস্ব অর্থে নগর ভবন নির্মাণ কাজ শেষ করব। প্রথমে তিনটি ফ্লোর করব। এরপর বাকি কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করব। নান্দনিক আইকনিক নগর ভবন নির্মাণ করা হবে জানিয়ে মেয়র বলেন, পেছনে যে জায়গা রয়েছে সেটাও আমরা নিয়ে ফেলেছি। এতে জায়গার পরিমাণ বেড়েছে। আশা করছি খুব সুন্দর একটি ভবন হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, পৌরসভা হয়ে সিটি কর্পোরেশনের বয়স ১৬০ বছরের বেশি। এসময়ে একটি নান্দনিক নগর ভবন হওয়া প্রয়োজন ছিল। মহিউদ্দিন ভাই (প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী) উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে সেটা আর হয়নি। নগর ভবন নিয়ে আমাদের একটি প্রকল্পও আছে। রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের বিল্ডিং ডিভিশনে ভেটিং করতে দিয়েছিল। সেটা সম্পন্ন হয়েছে। প্রি–একনেকে পাশ করালাম। আশা করছি সেটাও পাশ হবে। তবে এর মধ্যে নিজস্ব অর্থে কাজ শুরু দিচ্ছি। চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগর ভবনের বেইসমেন্টসহ তিনটি ফ্লোর (অবকাঠামোগত) নির্মাণে গত ১ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২ জুলাই ছিল দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। ‘তাহের ব্রাদার্স’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজের জন্য চূড়ান্ত করা হয় বলে আজাদীকে জানিয়েছেন চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম। এদিকে বিদ্যমান ভবনটি ভেঙে নিলামে বিক্রির জন্য ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করে চসিক। পরবর্তীতে ৭০ লাখ টাকায় ‘জাবেদ এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত করা হয়। তবে নতুন ভবন নির্মাণ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এতদিন পুরানো ভবনটি ভাঙার প্রক্রিয়া থমকে ছিল। সর্বশেষ সিটি মেয়র নিজস্ব অর্থে নগর ভবন নির্মাণে সিদ্ধান্ত দেয়ার পর পুরাতন ভবন ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পুরাতন ভবন ভাঙার পর ওই জায়গাসহ ৫৩ দশমিক ৪৫ কাঠা জায়গায় নগর ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, দুইটি বেইসমেন্ট ফাউন্ডেশনসহ তিনটি পার্কিং থাকবে এবং এর দুইটি হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী এটি হবে ‘আইকনিক’ ভবন। ভবনের ওপরে থাকবে সিটি ক্লক। ভবনের তিনপাশে সাজানো বাগান থাকবে। নির্মাণ করা হবে ফোয়ারা। ভবনের কয়েকটি ফ্লোর বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেয়া হবে। থাকবে মাল্টিপারপাস হল, কনফারেন্স হল ও ব্যাংকুয়েট হল।
জানা গেছে, আন্দরকিল্লাস্থ নগর ভবনটি চসিকের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হতো। ২০১৯ সালের ২০ জুন তা টাইগারপাসের অস্থায়ী কার্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে ভবনটিতে আঞ্চলিক কার্যালয় এবং নেজারত শাখার অফিস হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল। সরেজমিনে গতকাল বুধবার দুপুরে এ ভবনে দেখা গেছে, সেখানে একটি নোটিশ দেয়া হয়েছে। এতে লেখা রয়েছে, ‘সাবধান। ৩২ নং আন্দরকিল্লাহস্থ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পুরাতন ভবন ভাঙা ও অপসারণের কাজ চলছে। সর্বসাধারণকে নিরাপদ দূরত্বে চলাচলের জন্য অনুরোধ করা হল’। এসময় সেখানে দায়িত্বরত এক নিরাপত্তাকর্মী আজাদীকে জানান, ভবন থেকে আসবাবপত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তা আজাদীকে বলেন, নেজারত শাখার কার্যক্রম সরিয়ে নিলে আগামী সপ্তাহ থেকে পুরাতন ভাঙা শুরু হবে।
চসিকের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পুরাতন ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৯৬৪ সালে। তবে চসিকের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ৬০ এর দশকের শেষে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। শুরুতে তিন তলা পর্যন্ত ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে চসিকের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেলে তা ছয় তলায় উন্নীত করা হয়।
সাবেক এ মেয়র বলেন, বর্তমানে যেখানে শপিং কমপ্লেঙ আছে সে জায়গাটি এবং আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠ নিয়েছিলাম নগর ভবন করার পরিকল্পপনা থেকে। কারণ নগর ভবন এমন জায়গায় হওয়া উচিত যার চতুর্দিকে জায়গা থাকবে এবং অবস্থানটাও হতে হবে উপযুক্ত স্থানে। সেখানে করা যায়নি। এখন শেষ পর্যন্ত আন্দরকিল্লায় নগর ভবন হচ্ছে তাও খুব ভালো।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পুরাতন ভবনটির পাশে ১৮৬৪–৬৫ সালের দিকে নির্মিত আরেকটি ভবন ছিল। প্রথমে ওই ভবন থেকে চসিকের কার্যক্রম পরিচালিত হত। ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় ২০০৯ সালে ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে ২০১০ সালের ১১ মার্চ নগর ভবন নির্মাণে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরবর্তীতে নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলে নগর ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মোহাম্মদ মনজুর আলম মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নগর ভবন নির্মাণে অনুমোদন দেয়। এরপর বিভিন্ন জটিলতায় প্রায় তিন বছর কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৪ সালে পুনরায় কাজ শুরু হয়। কিছুদিন যেতেই অর্থাভাবে আবারও কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে ২০১৫ সালে ৭৪ কোটি টাকায় ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। ২০১৭ সালে ডিপিপি’টি সংশোধন করা হয় ১২০ কোটি টাকায়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের র্মাচ মাসে ২০২ কোটি ২৪ লাখ টাকায় ২৩ তলা নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি সে প্রকল্প। যা সংশোধন করে ২২৯ কোটি টাকা করা হয়। চসিক গত মার্চে মূল প্রকল্প থেকে তিনটি ফ্লোর কমিয়ে ২০ তলা নগর ভবনের ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ২০২ কোটি। যদিও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না অর্থ মন্ত্রণালয়।












