দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

থাই এয়ারওয়েজের বোয়িং এর দিকে তাকিয়ে আছি। চকচক করছে। মনে হচ্ছে একেবারে নতুন। অবশ্য বিশ্বের বহু দেশের এয়ারলাইন্সই পাঁচ বছরের বেশি পুরানো এয়ারক্রাফট ব্যবহার করে না। নিজেদের বহরে পাঁচ বছর চালানোর পর এয়ারক্রাফটগুলো অপেক্ষাকৃত কম ধনী রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। কখনো কখনো ইজারাও দিয়ে দেয়া হয়। নিজেদের বহরকে সুরক্ষিত রাখতেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এয়ারলাইন্সগুলো এমনটি করে থাকে। আমাদের ধনী লোকদের গাড়ি পাল্টানোর মতো বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো এয়ারক্রাফট পাল্টায়। দেশে অনেক ধনী মানুষই পাঁচ বছরের বেশি পুরানো গাড়ি ব্যবহার করেন না, পাল্টে ফেলেন। অনেকেই শখ করে বছর বছর মডেল পাল্টান। এই ধরনের এক একটি এয়ারক্রাফটের দাম যেখানে পাঁচশ’ থেকে এক হাজার কোটি টাকা সেখানে শখ করে কিছু করার সুযোগ কম, তবে কর্পোরেট স্বার্থেই মডেল না পাল্টালেও নয়া এয়ারক্রাফট বহরে যোগ করা হয়। কোম্পানির ইমেজ এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতেই তারকা এয়ারলাইন্সগুলো প্রায়শঃ নিজেদের বহর থেকে পুরানো এয়ারক্রাফট সরাতে থাকে।

থাই এয়ারের বোয়িংটি ক’বছরের পুরানো কে জানে। ঢাকাব্যাংকক রুটে একেবারে নতুন এয়ারক্রাফট দেয়ার কথা নয়। আকাশ পথের যোগাযোগে দেশ যত উন্নত সুযোগ সুবিধা ততই বাড়তে থাকে। উন্নত দেশের রুটে নতুন নতুন এয়ারক্রাফট দেয়া হয়। আমেরিকা ইউরোপের বহু দেশ তো পুরানো এবং ইমেজ ক্রাইসিসে ভোগা এয়ারলাইন্সে তাদের দেশে নামারও অনুমতি দেয় না। নিয়মিত ফ্লাইট অপারেটর তো দূরের কথা।

দেশ যত উন্নত সার্ভিস ততই চোখ ধাঁধানো। দেশ পরিবর্তনের সাথে সাথে এয়ারলাইন্সের সার্ভিসেও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একই এয়ারলাইন্স পৃথক পৃথক দেশে পৃথক পৃথক ক্যাটাগরির সার্ভিস দেয়। দেশের ভিন্নতায় সার্ভিসে আকাশ পাতাল পার্থক্য হয়ে যায়। পার্থক্য হয়ে যায় আচার আচরণে। পরিবর্তিত হয় এয়ারক্রাফটের ধরনও। এমিরেটস এয়ারলাইন্সে আমেরিকার লসএঞ্জেলস ভ্রমণের কথা মনে পড়লো। ঢাকা থেকে দুবাই এবং দুবাই থেকে লসএঞ্জেলস রুট। মজার ব্যাপার হলো ঢাকা থেকে দুবাই পর্যন্ত ঘন্টা চারেকের ফ্লাইটে এমিরেটসের এয়ারক্রাফট থেকে শুরু করে কেবিন ক্রুদের যে সার্ভিস তা যেনো আমূল পাল্টে গেলো দুবাই থেকে লসএঞ্জেলসের ফ্লাইটে। কেবিন ক্রুদের চেহারাও যেনো অনেক বেশি শানদার হয়ে উঠেছিল। শুধু বাছাই করা সুন্দরীদেরই নয়, বিমানের ভিতরের খাবার দাবারের মান থেকে শুরু করে আচার ব্যবহার সবই পাল্টে গিয়েছিল।

শুধু কী এমিরেটস! সিংগাপুর এয়ারলাইন্সে একবার জাপান যাচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে সিংগাপুর পর্যন্ত রুটের ব্যবহারের সাথে সিংগাপুর থেকে টোকিও’র ব্যবহার আমূল পাল্টে গিয়েছিল। এভাবে প্রায় প্রতিটি এয়ারলাইন্সেরই উন্নত এবং অনুন্নত দেশের সার্ভিসে পার্থক্য থাকে। এটাই যেনো কর্পোরেট দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম। ধনী আর গরিবের পার্থক্য শুধু মানুষে নয়, বিমানে বিমানেও চলে!

ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থাই এয়ারের বোয়িং এর দিকে তাকিয়ে আরো নানা কথা মনে পড়ছিল। একা বসে থাকলে দুনিয়ার কত ভাবনা যে ভিড় করে!

যাত্রীদের বোর্ডিং করার জন্য ডাকা হলো। একটি হুলস্থুল অবস্থা। কার আগে কে লাইন ধরবে, কার আগে কে বিমানে চড়বে!! আমাদের অনেকের ধারণা আগে লাইনে না দাঁড়ালে বিমান রেখে চলে যাবে। অথচ বিমানের চড়ার আগ দিয়ে এখন আর আগে পরে লাইনে দাঁড়ানোর উপর তেমন কিছু নির্ভর করে না। সিট নির্ধারিত হয়ে গেছে। এখন শুধু বিমানে চড়ে নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসলেই হলো। অবশ্য, কিছু কিছু অবিবেচক যাত্রী নিজের সিটের ওভারহেড কেবিনে ব্যাগ না রেখে অন্য সিটের কেবিনে রেখে দেয়। আবার কেউ কেউ কেবিন ব্যাগের পাশাপাশি ল্যাপটপের আদলেও একটি ব্যাগ বহন করেন। ওজন ফাঁকি দেয়ার জন্য ধান্দাটি করা হয়। এই দ্বিতীয় ব্যাগটিকেও কেবিনে ঢুকিয়ে রাখেন তারা। এতে করে বিমানে আগেভাগে না উঠে পরে চড়লে নিজের ওভারহেড কেবিন বেহাত হওয়ার আশংকা থাকে। অবশ্য সবসময় এমন অনাচার ঘটে না, মাঝে মধ্যে ঘটে। এখন আমার যেহেতু কোন কেবিন ব্যাগই নেই, তাই ওভারহেড কেবিন নিয়ে চিন্তা করছিলাম না। কেউ নিয়ে নিলেও আমার কোন অসুবিধা হবে না, না নিলেও সমস্যা নেই।

বিমানে চড়ে বসলাম। উইন্ডো সিট। অভ্যাসবশতঃ চোখ চলে গেলো ওভারহেড কেবিনে। ব্যাগের জন্য মুখ হা করে তাকিয়ে আছে, মানে খালি। উইন্ডো সিটে বসলে বাইরে চোখ চলে যায়। অনেকগুলো এয়ারক্রাফট দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ বিমানেরও কয়েকটি এয়ারক্রাফট দেখলাম। আহা, আমাদের বিমানের বহরটা কেনো যে থাই এয়ারের মতো হলো না!!!

বিমান চলতে শুরু করেছে। বাসের মতো গতি নিয়ে এগুচ্ছে রানওয়ের দিকে। এত বড়ো বিমান কি করে যে বাসের মতো চলে! কেবিন ক্রুদের দৌড়াঝাপ চলছে। সিটবেল্ট থেকে শুরু করে নানা সতর্কতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। বিমান পানিতে পড়ে গেলে, কিংবা অক্সিজেন না পেলে কি করতে হবে তাও অবলীলায় বলে দেয়া হচ্ছে। এসব শুনতেও ভয় লাগে!

ঢাকা থেকে ব্যাংককের দূরত্ব প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার। আমাদের এয়ারক্রাফটটি কত বেগে যাচ্ছে ঠিক জানি না। তবে এগুলো সচরাচর আটশ’ থেকে এক হাজার কিলোমিটার বেগে চলে। অর্থাৎ ব্যাংকক পৌঁছাতে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগতে পারে। ব্যাংককে আবার তিন ঘন্টার অপেক্ষা। অতপর পৃথক ফ্লাইটে আমাকে হংকং এর পথ ধরতে হবে।

থাই সুন্দরীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আমি এক বোতল পানি দেয়ার অনুরোধ করলাম। চ্যাপ্টা নাকের থাই তরুণী আমাকে মিনি সাইজের এক বোতল পানি দিল। যাত্রীদের নাস্তা দেয়ার তোড়জোড় চলছে। তেমন কোন ক্ষুধা না থাকলেও নাস্তা করলাম। কফি না নিয়ে চা দিতে বললাম। ছুটছিল আমাদের বিমান। তিন ঘন্টার মতো সময় লাগবে। তাই আমি ঘন্টা খানেক ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। ইকোনমি ক্লাসের সিট ঘুমানোর জন্য কোনভাবেই যুতসই নয়। তবুও

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম কে জানে! কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেটাও মনে নেই। শুধু ঘুমাতে চেয়েছিলাম সেটা মনে আছে। রাতে ঘুম হয়নি। তাই শরীর বেশ কাহিল ছিল। তাই আরামদায়ক বিছানা না হলেও বিমানের সিটে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম ভাঙ্গার পর বেশ ফুরফুরে লাগছিল।

কতদূর এসেছি বা আর কতক্ষণ লাগবে তাৎক্ষনিকভাবে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হলো আর আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো। একটু কফি হলে দারুন হতো। বিমান ল্যান্ডিং শুরু করলে আর দেবে না। তাই আমি কল লাইটের আলো জ্বালালাম। বেশ দ্রুত সাড়া পেলাম। এক তরুণী এসে আমার সামনে কিছুটা ঝুকে দাঁড়ালেন। আমি হাসি ঝুলিয়ে বললাম, একটু পানি এবং সাথে একটু কফি যদি পাওয়া যায়। তরুণী হাসলেন। পানি দিচ্ছি, তবে কফি—-। বেচারি কেমন যেন ঢোক গিললেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, ঢাকা ব্যাংকক রুটের যাত্রীর এর থেকে বেশি কদর পাওয়ার কথা নয়। নাস্তার সাথে চা কফি দেয়া হয়েছে। আর দেয়া হবে না। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে, তরুণী আমার জন্য প্লাস্টিকের গ্লাসে পানি এবং কপি নিয়ে আসলেন। আমি মুগ্ধতা নিয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম।

ঘুম ভাঙ্গা শরীরে কফি যেনো ওষুধের মতো লাগছিল।

বিমান উড়ছিল। ছুটছিলাম গন্তব্যে। কিছুক্ষণ পরই ল্যান্ডিং এর ঘোষণা দেয়া হলো। বাইরের তাপমাত্রা এবং লোকাল টাইম বলে দেয়া হলো। এসব এখন আর না বললেও চলে। সবই তো গুগুল বিমানে চড়ার আগেই জানিয়ে দেয়। নতুন করে আর সময় কিংবা লোকাল টাইম নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। মোবাইলের ঘড়ি অটো আপডেট হয়ে যায়, হাতের স্মার্টওয়াচ থাকলে সেটিও। বিজ্ঞান মানুষকে কত কিছু যে দিয়েছে!! বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলার মতো বিজ্ঞানের এক একটি আবিষ্কার আগেকার বড় বড় আবিষ্কারকে খেয়ে ফেলছে। এক মোবাইলই বিজ্ঞানের কত আজব আবিষ্কারকে দুনিয়া ছাড়া করতে চলেছে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভরা থাক, ভরা থাক স্মৃতিসুধায়
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসেনানী আবদুল্লাহ আল হারুন