অপহৃত কলেজছাত্রের কঙ্কালের খণ্ডিত অংশ উদ্ধার

রাউজানে পুলিশের কাছ থেকে আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করল বিক্ষুব্ধ জনতা, ৪ পুলিশ আহত

রাউজান প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

রাউজানে অপহৃত কলেজছাত্রের কঙ্কালের খণ্ডিত অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। মুরগির খামারে চাকরি নেওয়া ছদ্মবেশী উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে ১৩ দিন আগে অপহৃত হয়েছিলেন শিবলি সাদিক হৃদয় (১৯)। প্রধান আসামির দেখানো স্থান কদলপুর ইউনিয়নের পূর্ব পাশের পার্বত্য রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার রঙি পাহাড়ের চূড়া থেকে কঙ্কালের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। হৃদয় কদলপুর ইউনিয়নে মোহাম্মদ শফির পুত্র এবং কদলপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র। তিনি কদলপুরে একটি মুরগির খামারে ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। এদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধান আসামিকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে।

জানা যায়, গতকাল সোমবার সকালে পুলিশ অপহরণ মামলার প্রধান আসামি উমংচিং মারমার (২৬) স্বীকারোক্তি অনুসারে তাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় আসামির বর্ণনা ও পুলিশ মামলার এজাহারে বর্ণিত হৃদয়ের পরনের কাপড়চোপড় দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয় সেগুলো খুন করে ফেলে যাওয়া হৃদয়ের কাপড়। তাকে খুন করা হয়েছিল দুর্গম পাহাড় চূড়ায় থাকা কলাবাগানোর ভেতর। পুলিশ সেখান থেকে একটি মাথার খুলি, পায়ের দুটি নলা, হাতের একটি নলা ও রশি উদ্ধার করে। অবশ্য সেখানে দেহের অন্যান্য অংশ ছিল না।

এদিকে গতকাল সকালে পুলিশ আসামিকে নিয়ে হৃদয়ের লাশ উদ্ধারে গেছেএমন সংবাদ পেয়ে এলাকার কয়েক হাজার নারীপুরুষ আসামিকে নিয়ে আসার পথে রাস্তা অবরোধ করে রাখে। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা আসামি ছিনিয়ে নিতে পুলিশের দুটি গাড়িতে হামলা চালায়। উত্তেজিত জনতা গাড়ির দরজা ভেঙে আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় খুনের ঘটনায় জড়িত আসামি। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তাদের ওপরও হামলা করা হয়। আহত হয় চার পুলিশ।

কেন অপহরণ, কেন খুন : এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কদলপুর হযরত আশরাফ মাজার রোডের ভিতর যৌথ মালিকানাধীন একটি মুরগির খামারে যে কয়েকজন কর্মচারী ছিল তাদের মধ্যে চারজন ছিল উপজাতি যুবক। ওই খামারের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন খামারের পাশের বাড়ির হৃদয়। হৃদয়ের সাথে উপজাতি যুবকদের ভালো সম্পর্ক ছিল। কাজ করা নিয়ে কয়েক মাস আগে তাদের মাঝে বিরোধের সূত্রপাত হয়। সম্পর্কের তিক্ততার মাঝে উপজাতি যুবকরা চাকরি ছেড়ে চলে যায়। পরে মালিকপক্ষ তাদের ডেকে এনে হৃদয়ের সাথে বিরোধ মিটমাট করে দেয়। এরপর থেকে তাদের সাথে হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে ভাতও খাওয়ায়।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, এভাবে তারা হৃদয়ের সাথে সম্পর্ক গভীর করে পাহাড়ি এক তরুণীর ফাঁদে ফেলে। সূত্র মতে, ওই তরুণীর ডাকে সাড়া দিয়ে গত ২৮ আগস্ট রাতে হৃদয় খামার থেকে বের হয়েছিলেন। রাতে বাড়িতে না ফেরায় পরিবারের লোকজনের সন্দেহ বাড়তে থাকে। তার ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। পরিবারের সদস্যরা পরদিন এ নিয়ে খামারের মালিকের সাথে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শে থানায় জিডি করে।

পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখে। পাশাপাশি অনুসন্ধান শুরু করে। এর মধ্যে ফোন আসে হৃদয়ের বাবার নম্বরে। বাবা বাইরে থাকায় ফোনটি রিসিভ করেন তার মা মানহিদা আকতার। হৃদয় মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে জানান তিনি অপহরণকারীদের হাতে আটক আছেন। ১৫ লাখ টাকা দিলে তারা তাকে ছেড়ে দেবে। এই সংবাদে বিচলিত পরিবারটি আপনজনের কাছে পরামর্শ চায়। কেউ বলেছেন থানা পুলিশে এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ছেলের ক্ষতি হতে পারে। ভালো হবে অপহরণকারীদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ছেলেকে ফিরিয়ে আনা। এমন পরিস্থিতির মাঝে অপহরণকারীদের আরো একটি ফোন পান হৃদয়ের বাবা। ফোনে ছেলের মুক্তির জন্য দফারফা করেন দুই লাখ টাকায়। অপহরণকারীরা মুক্তি দেওয়ার শর্তে তাকে টাকা নিয়ে যেতে বলে বান্দরবানের ডলুপাড়ায়। তাদের কথামতো তিনি দুই লাখ টাকা নিয়ে সেখানে গিয়ে অপহরণকারীদের দেন। তিনি ছেলেকে ফেরত দিতে অনুরোধ করেন। অপহরণকারীরা উত্তরে বলে, তোর ছেলে টেঙি স্টেশনে আছে। সেখানে যা। সেখানে না পেয়ে আবার যোগাযোগ করলে বলে, ওখানে যা, সেখানে যা, খুঁজে পাবি। এভাবে সারা দিন সেখানে কাটিয়ে হতাশ মনে ফিরে আসেন হৃদয়ের বাবা শফি।

এসব ঘটনার পর ব্যর্থ হয়ে হৃদয়ের মা থানায় গিয়ে ছয়জন নির্দিষ্ট এবং অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজনকে আসামি করে থানায় অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ ওইদিনই অভিযান চালিয়ে কাউখালী উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করে উহ্লাপ্রমং মারমার ছেলে ঊক্যথোয়াই মারমা(১৯) ও কাপ্তাই থানার চিৎমরম আমতলী থেকে উষাচিং মারমার ছেলে আছুমং মারমাকে। পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সাথে নিয়ে অভিযান চালানো অব্যাহত রাখে। এই ধারাবাহিকতায় গতকাল ভোর রাতে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে হৃদয়ের কঙ্কাল উদ্ধার হলো।

রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, গত রবিবার মামলার ১ নং আসামি উমংচিং মারমাকে আটক করে আমরা ২৫ পুলিশ সদস্য নিয়ে আজ (সোমবার) ভোরে তার দেওয়া তথ্যমতে কদলপুররাঙ্গুনিয়া সীমান্তবর্তী দলুছড়ি পাহাড়ি এলাকায় অভিযানে যাই। অপহৃত কলেজ ছাত্রের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয় পাহাড় থেকে। সেখানে ১ নং আসামিকে দেখে স্থানীয় কয়েকশ উত্তেজিত জনতা গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। আমাদের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। বিক্ষুদ্ধ জনতার হামলায় চারজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তারা রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পুলিশের উপর হামলাকারী ও আসামি ছিনতাই করে নিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলার প্রক্রিয়া চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভেঙে গেল এক পরিবারের স্বপ্ন
পরবর্তী নিবন্ধ৪৩৭ বছর পর পৃথিবীর কাছে ধূমকেতু ‘নিশিমুরা’