দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জনমনে আশংকা ও আতঙ্ক ক্রমে ভর করছে। এর প্রভাব বেশি অনুভূত হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর ব্যাপক জনগোষ্ঠী এবং অতীতে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অস্থিতার বারংবার অসহায় শিকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে। মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, ব্যাপক লুটপাট, অর্থ পাচার অর্থনীতির ক্রম অধোগতিতে মানুষ দিশাহারা। ব্যাংকিং ও জ্বালানি খাতে বৃহৎ পুঁজির অবাধ লুটপাট ও তাদের স্বার্থে প্রণীত নীতির কারণে অর্থনীতির সামগ্রিক সংকট বৃদ্ধ পাচ্ছে। এরি অনুষঙ্গ হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে লুটেরা পুঁজির রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও প্রয়োজনেই সমাজে রাজনীতিতে ক্রমে বিকশিত হয়ে আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে ধর্মান্ধ শক্তি। অন্ধ ধর্মাচারে, সাম্প্রদায়িকতায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে পুরো সমাজ মানস। সংখ্যাগুরুদের কথিত অনুভূতির দাপটে দুর্বল সংখ্যালঘুদের অনুভূতি হারিয়ে গেছে। গণতন্ত্রহীনতার দীর্ঘ পরিবেশে অব্যাহত ভাবে পুষ্ট হয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংস্কতি ক্রমে প্রকৃত ধার্মিকতাকে (Piety) গ্রাস করে ফেলেছে ও উগ্রতর হয়ে উঠেছে ‘ধর্মতন্ত্র’ বা ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ (Religiosity) এবং নিজ নিজ ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের অন্ধ অহমিকা। লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হবে আমাদের সমাজে সামগ্রিকভাবে ষাটোর্ধ মানুষের মধ্যে যে মানবিক সহনশীলতা, মমত্ববোধ, উদার বিশ্বাস, এখনো রয়েছে তা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত বরং ধর্মের নামে অন্ধ বিশ্বাস ও আচারের চর্চা, পরধর্ম ও মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, একরৈখিক উগ্রতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রচন্ড ভোগাবাদিতা যুক্তি ও মুক্ত ভাবনার প্রতি অযৌক্তিক ঘৃণা তারুণ্যের মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। স্বার্থপরতা, শঠতা, অন্ধ সংকীর্ণতা স্থান নিয়েছে ’৬০ ও ’৭০ এর দশকের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগে স্থির প্রতিজ্ঞ, উদ্দীপ্ত তারুণ্যের দেশপ্রেমের উদ্দাম প্রাণচাঞ্চল্য। পরোপকারিতা, পরধর্র্ম ও পরমত সহিষ্ণুতা, দেশপ্রেম কোন সহজাত ব্যাপার নয়, এটা নিয়ত চর্চা ও শিক্ষার ব্যাপার। জীবন ও জগতের নানা প্রপঞ্চের প্রতি শিক্ষার্থীর কৌতুহল সৃষ্টি করা এবং সেই কৌতুহল মেটানোর মুক্ত ও অবাধ পথের নাম শিক্ষা কিন্তু যে শিক্ষা otherবা অপরকে ভালবাসার পরিবর্তে ঘৃণা করতে শেখায়, চক্ষুম্মানকে অন্ধ করে দেয় তা কোন শিক্ষা হতে পারে না। সেই কুশিক্ষা সমাজের সামগ্রিক অধোগতি তীব্র করেছে। শিক্ষার বিকৃতি ও সাম্প্রদায়িকীকরণ যে আজকের এই ক্রান্তিকালের সংকটের মূল উৎস তা হয় আমাদের বোধের মধ্যেও নেই অথবা সেই অপ্রিয় সত্যকে আমরা অপ্রিয় বিবেচনায় এড়িয়ে চলেছি। পাকিস্তান আমলের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের দীর্ঘ ছায়ার মধ্যেও ছাত্র গণ আন্দোলনের প্রগতিমুখীন গতি প্রকৃতির স্বরূপ সন্ধান, বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণে জরুরী।
শৈশব– কৈশোরের মানস গঠন প্রক্রিয়ার মূল উপাদান হল দুটি। একটি হল শিক্ষা বিশেষ করে উদার ও সংস্কার মুক্ত, পারিবারিক ও সর্বজনীন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর দ্বিতীয়টি হল সামাজিক– সংস্কৃতি যা আবার প্রথমটির উপজাত মাত্র। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত মূলধারার ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ব্যক্তিগত জীবনাচার, ত্যাগ, প্রতিজ্ঞা, দেশপ্রেম যে কোন বিচারে আজকের ভোগ সর্বস্বতার তুলনায় ছিল অনাড়ম্বর অথচ উন্নততর। মতপার্থক্য, দোষগুণ, সীমাবদ্ধতা কম বেশি সবার ছিল কিন্তু ‘ইহজাগতিক জীবন বোধ’, অসাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ ধর্মাচার, অযৌক্তিক বিশ্বাস ও সংস্কার বিরোধী মন ও মনন, প্রগতিশীলতা, সমাজ ও সুস্থ রাজনীতির এসব অত্যাবশ্যকীয় সদর্থক উপাদান তখন নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল লক্ষনীয়। সেই সময় জাতীয় রাজনীতির নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন, মওলানা ভাসানী, মনি সিং, মোজাফফর আহমদ এঁদের মত আজীবন ত্যাগী, উদার অসাম্প্রদায়িক, জনকল্যাণে নিবেদিত নেতারা ছিলেন তারুণ্যের রোল মডেল। এঁদের নিছক মধ্যবিত্তসুলভ বা কারো কারো একেবারে ত্যাগী ব্যক্তিজীবন ছিল সব বির্তকের উর্ধ্বে। মানুষকে তাঁরা ধর্ম পরিচয়ে বিচার করেননি। ধর্মকে তাঁরা একান্ত ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রাখতেন। মানুষ তখন উন্নত ইহজাগতিক জীবনের স্বপ্নে বিভোর ছিল। এক্ষেত্রে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ধর্মান্ধতা ও লুটেরা রাজনীতির পুনরুত্থানের একটি প্রধান কারণ বটে কিন্তু ’৭১ এর পূর্বাপর সময়ের রাজনীতির গুণগত মান, অসম্প্রদায়িক, উন্নত সমাজ মানস ও ছাত্র সমাজের পরিশীলিত সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে কাজ করেছিল মূলত সে সময়ে প্রচলিত সাধারণ শিক্ষা যা ছিল গুণে মানে আজকের বহুধা বিভক্ত অত্যন্ত নিম্নমানের শিক্ষার তুলনায় অনেক উন্নত।
তীব্র সাম্প্রদায়িক জজবার মধ্যে জন্ম নেয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় থেকে ঐতিহাসিক কারণে শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। সারা প্রদেশের খুলনার ব্রজলাল বা বিএল কলেজ থেকে সিলেটের মুরারী চাঁদ ও মদন মোহন কলেজ এবং চট্টগ্রামের স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে রং পুরের কার মাইকেল কলেজ দুই একটি ছাড়া প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব কলেজ এবং প্রত্যেক থানায় তখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত দুয়েকটি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় শিক্ষানুরাগী বিত্তশালী হিন্দুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদেশের উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে এবং শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই ঐতিহাসিক সত্য বর্তমান প্রজন্ম জানে না বা যারা জানেন তাঁরা এটাকে স্বীকার করেন না। কিন্তু ইতিহাসের সত্য গোপন থাকে না। তখন শিক্ষার মান ও পরিবেশ ছিল নিভৃত ও উন্নত। ছাত্র–শিক্ষক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত পরিশীলিত এবং সিংহভাগ শিক্ষক ছিলেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আগত। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মেধাবী উদার, উচ্চ নৈতিক মান সম্পন্ন ও আন্তরিক এসব শিক্ষক ছিলেন পাঠদানে তুখোড়। সে সময় প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা ছিল বলতে গেলে একমুখী, সেকুলার এবং পুরোপুরি বিজ্ঞান মনস্ক না হলেও অনেকটা সংস্কার মুক্ত। অপপ্রচার সত্ত্বেও ’৫০ ও ’৬০ দশকে উঠতি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি সেদিন এসব শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ছিল প্রচন্ড শ্রদ্ধাশীল। সমাজের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠানেই পাঠ গ্রহণ করত। ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে তাঁরা এসব শিক্ষকদের সমাজে সম্মানের উচ্চ শিখরে স্থান দিয়েছিলেন অন্তর থেকে। এই শিক্ষা গড়ে তুলেছে অসাম্প্রদায়িক তারুণ্য যে তারুণ্য আবার উদ্দীপ্ত হয়েছে মানুষকে, দেশকে ভালবাসার মানবিক তাগিদে। এ জন্য ’৭১ সালে পাক বাহিনীর টার্গেট করেছিল রাজনীতি বিচ্ছিন্ন এসব হিন্দু শিক্ষকদের। পাকিস্তান সরকার বার বার শিক্ষার এই অসাম্প্রদায়িক ও উদার চরিত্র নষ্ট করতে চেয়েছে বিশেষ করে সামরিক শাসক আইয়ুব খান। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িকতার কৃত্রিম জজবা তৈরি করার চেষ্টা হয় যাতে দেশে বিরাজমান অসাম্প্রদায়িক সমাজ মানস ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলুষিত করা যায় এবং সামরিক শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখা যায়। কিছু মানুষ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হলেও এর কোন প্রভাব বিস্তীর্ণ ও নিস্তরঙ্গ বিশাল গ্রাম বাংলার হিন্দু শিক্ষক প্রভাবিত সিংহ ভাগ গ্রামীন স্কুল কলেজগুলোতে পড়েনি। আইয়ুব জমানার শেষের দিকে দেশের তিন প্রান্তের তিনটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও শতাধিক কলেজ তখন প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে ছিল মুখর ও প্রাণচঞ্চল। একটি উন্নত, একমুখী, বিজ্ঞানমনস্ক, সর্বজনীন সেকুলার শিক্ষা ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক এগার দফার অন্যতম দাবী ছিল। যে এগার দফা ৬ দফার সাথে যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে এক দফায় রূপ নিয়ে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে এদেশের জন্ম দিয়েছে। কাজেই পাকিস্তানের ২৩ বছরে বিরাজিত মোটামুটি সেকুলার ও মানবিক ভাবনায় ঋদ্ধ শিক্ষা পরিবেশের প্রভাবে সৃষ্ট আন্দোলন ও সামাজিক আবহে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। বলা বাহুল্য হবে না যে এ সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক চেটিয়া লুটেরা কোন বাঙালি পুঁজির মালিক ছিল না– যে দু একজন বাঙ্গালী শিল্পপতি গড়ে উঠেছিলেন তাঁরা আজকের লুটেরা পুঁজির মালিকদের মত চরিত্রহীন ও অমানবিক ছিলেন না। তবে সাম্প্রদায়িকতার একটি আপাত দুর্বল হয়ে পড়া ধারা তখনো সমাজে ছিল। যা মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষের হতাশা, নানা ঘটনা ও গুজবের মাধ্যমে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। সমাজে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রাধান্যে শিক্ষা প্রাইভেটাজেশন বা শিক্ষা বাণিজ্য তখন ছিল অচিন্তনীয়। ফলে শিক্ষার নানা বিভক্তি দেখা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধের পরে শিক্ষা পরিস্থিতি রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিবর্তনের সাথে পাল্টে যায়। শিক্ষা বিভক্ত হয়ে পড়ে কয়েকটি স্বতন্ত্র ধারায়। এ নিয়ে বারান্তরে আলোচনার ইচ্ছে রইলো।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক; প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট












