বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। সৌন্দর্যের দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে রূপের রাণী। এর চারপাশে যেন রূপের আধার! কী নেই আমাদের এই দেশে! এ দেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর অপূর্ব বনাঞ্চল সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভূমি সিলেট, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি–আচার সমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভূমি ঘেরা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইত্যাদি। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে উন্নয়নের সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।
বর্তমান পৃথিবীতে পর্যটন একটি সমৃদ্ধ এবং সফল শিল্প। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যাদের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত এই পর্যটন শিল্প। শুধু তাই নয়, এই শিল্প এবং শিল্প সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ জড়িত থাকে। ফলে একটি দেশের বেকার যুবকদের একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ১১ জনের মধ্যে গড়ে ১ জন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই তথ্য থেকেই পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণশীলতা অনুমান করা যায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা খুব একটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারিনি। এই খাতটি থেকে সরকারের বিপুল অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা থাকলেও বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। পর্যটন শিল্প বিকাশের পথে আমাদের পর্বত প্রমাণ সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন খুব একটা সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি, তেমনি যাতায়াত খরচও তুলনামূলক বেশি হওয়ায় আমরা পর্যটক আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছি।
‘পর্যটন’ অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত, এমন ধারণার বিকাশ ঘটে পঞ্চাশ–ষাটের দশকে। তবে আমাদের দেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পর্যটন শিল্পের চিত্র এখনো অনেক বিবর্ণ। পর্যটন যে আমাদের অর্থনীতির একটি বিশাল খাত হতে পারে এ ধারণার বিকাশ ঘটে মূলত গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। এরপর ১৯৯৯ সালে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যার ধারাবাহিকতায় পর্যটন বোর্ড ২০১০ সালে গঠন করা হয়।
দেশের পর্যটনকে এগিয়ে নিতে যে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা তৈরী করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, বিদেশি পর্যটকদের আধুনিক ও চিত্তবিনোদনের সব সুযোগ–সুবিধা সৃষ্টি করা হবে। কক্সবাজার ও সুন্দরবনের জন্য নেওয়া হবে মহাপরিকল্পনা। পর্যটন খাত বিকাশে বার্ষিক ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু এই কথাগুলোও এখনো গ্রন্থেই আছে। আর যথারীতি এখনো বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশের পর্যটন সক্ষমতা তলানিতেই আছে। অথচ বাংলাদেশের সম্ভাবনা ছিল বিশ্বের দেড়শো কোটি পর্যটকের বড় অংশের গন্তব্য হওয়ার। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিল(ডব্লিউটিটিসি) তাদের ২০১৪ সালের প্রতিবেদনেই বলে রেখেছিল বিশ্বের যে ২০টি দেশ পর্যটন খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি করবে, তার একটি বাংলাদেশ।
সকলেই স্বীকার করবেন যে, আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি দেশেই পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনের আয় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। অথচ বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প একটি অবহেলিত খাত; যদিও শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। অপার সম্ভাবনার এই খাত নানা অবহেলায় বিকশিত হতে পারছে না। পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় ও উন্নত করে তুলতে সরকারি পর্যায়েও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যেসব দেশে সমুদ্রসৈকত আছে, সেখানে সারা বছর পর্যটকের আধিক্য থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশে। সমুদ্রসৈকত শুধু নয়, আমাদের দেশে পাহাড়ও আছে, আছে দর্শনীয় অনেক ঐতিহাসিক পর্যটন স্পট। তার পরও আমরা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারছি না।
প্রতি বছরের মতো এবারও আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এবারের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ট্যুরিজম এবং ডিজিটাল রূপান্তর। বাংলাদেশে ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার–প্রচারণা চালানোর কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে। কিন্তু শুরু থেকেই এক ধরনের স্থবির অবস্থা দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়া ও ওয়েবসাইটে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) পর্যটন বিষয়ে প্রচারণার জন্য যে কয়টি কার্যক্রম হাতে নেয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘সোশ্যাল মিডিয়া প্রমোশন’। বিস্ময়কর হলেও সত্য ডিজিটাল বাংলাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রমোশন কারো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। পর্যটনকেন্দ্রগুলোর যথাযথ উন্নয়ন করা সম্ভব হলে বিদেশি পর্যটকদের পাশাপাশি দেশের পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করা সহজ হবে।