চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শাটল ট্রেনে দুর্ঘটনার পর পরিবহনে প্রশাসনের উদাসীনতার অভিযোগ এনে ক্যাম্পাস জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে কতিপয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী। তবে কে বা কারা এ তাণ্ডব চালিয়েছে প্রশাসন চিহ্নিত করতে পারেনি। ক্যাম্পাস জুড়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের সঙ্গে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপ–গ্রুপের নেতাকর্মীরাও জড়িত ছিল বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় তিনটি মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে নুয়ে পড়া গাছের ডালের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শাটল ট্রেনের ছাদে বসা অন্তত ২৩ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। কয়েকজনের মাথা ফেটে যায়। এছাড়া কয়েকজন চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে নিচে পড়ে যান। এরপর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে শুরুতে জিরো পয়েন্টে অবস্থিত পুলিশ বক্স ভাঙচুর ও জিনিসপত্র জ্বালিয়ে দেয়। এরপর পরিবহন সংকটের আন্দোলন রূপ নেয় তাণ্ডবলীলায়। এ সময় এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে তারা উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালায়। বাসভবনে থাকা প্রত্যেকটি জিনিস চুরমার করে দেয়া হয়। দামী দামী সব জিনিসপত্র ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয়। পরে অগ্নিসংযোগও করে সেখানে। এরপর শিক্ষক ক্লাব এবং পরিবহন দপ্তরে থাকা অন্তত ৬৫টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পুরো ক্যাম্পাস যেন ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। এ রকম ঘটনা এর আগে এ ক্যাম্পাসে ঘটেনি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আন্দোলন থেকে উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক ক্লাব এবং পরিবহন ভাঙচুরসহ ন্যক্কারজনক ঘটনায় ৩টি অজ্ঞাত মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় আরও মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫টায় চবি উপাচার্যের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন উপাচার্য নিজেই।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আহতের সংখ্যা প্রায় ২০ এর অধিক। এরমধ্যে তিনজনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, আন্দোলনের একপর্যায়ে চবি ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক উপ–গ্রুপ ভিএঙ ও সিঙটি নাইনের অনুসারীরা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়ালে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়েন। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের একাংশের অনুসারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এসময় তারা আন্দোলনে জামায়াত–বিএনপির ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করেন। ছাত্রলীগের এমন বক্তব্যের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরও একই বক্তব্য দেন গণমাধ্যমে। পরবর্তী আন্দোলনকে ঘিরে ছাত্রলীগের অনুসারীদের বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের ভাঙচুরের সময় প্রক্টরিয়াল বডির কেউই উপস্থিত হননি। ভাঙচুর করার সময় প্রক্টরিয়াল বডির একটা অংশ শিক্ষক ক্লাবে অবস্থান নেয়। সেখানে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বলে জানায় প্রক্টরিয়াল বডি। তবে শুধু এ ঘটনা না সামপ্রতিক কয়েকটি ঘটনায় প্রক্টরিয়াল বডিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেন, গতকাল গার্ডকে হত্যা করার চেষ্টা চালানো হয়েছে, সেখানে আমি থাকলে আমাকেও মেরে ফেলতে চাইতো। তিনি বলেন, গতকালের ভাঙচুরের বিষয়ে তিনটি মামলা করা হয়েছে। ভিসির বাসভবনে ভাঙচুর, পরিবহন দপ্তরে ভাঙচুর, গার্ড বা ভিসি হত্যাচেষ্টায় ‘এটেম্ট টু মার্ডার কেস’ এই তিনটি বিষয়ে মামলা করা হয়েছে। সেগুলো ফুটেজ দেখে করা হবে। আর আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার বিষয়ে দায়িত্ব নিবে প্রশাসন। তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভাকক্ষে ভাঙচুরের ঘটনায় সংবাদ সম্মেলনে এসব বলেন উপাচার্য। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পর্ষদের দায়িত্বশীল শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার আজাদীকে বলেন, আমরা আহত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছি। আর এ ঘটনায় মামলা হচ্ছে। ব্যবস্থা নেয়া হবে। মামলার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি প্রক্টর।
জানা যায়, পুলিশ বঙ, উপাচার্য দপ্তর কিংবা পরিবহন দপ্তর ভাঙচুরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি নষ্ট করা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও বহুবার এরকম ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। যার তদন্ত কমিটি হয়েছে কিন্তু ফলপ্রসূ কোনো বিচার হয়নি। এরকম বিচারহীনতার কারণেই এরকম ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সাহস করেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এক্ষেত্রে সামপ্রতিক সময়ে নিয়োগ বঞ্চিত ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা সুযোগ সুবিধার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ক্ষোভের জায়গা থেকে এমনটা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। আহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে ভাঙচুরের বিচার দাবি করেছে সংগঠনটি।